চিংড়িঘেরে রূপ দিতে কাটা হলো দুই হাজার কেওড়া ও বাইন গাছ
ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :: চিংড়িঘেরে রূপান্তর করতে এবার কক্সবাজারের চকরিয়ায় সমুদ্র উপকূলীয় প্যারাবনের বড় সাইজের প্রায় দুই হাজার কেওড়া ও বাইন প্রজাতির গাছ কেটে সাবাড় করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত কয়েকদিন ধরে শ্রমিক দিয়ে এসব গাছ কেটে সাবাড় করা হয়। জনসমাগম এলাকা উপকূলীয় বদরখালীর মুহুরীরজোড়া স্লুইস গেট থেকে ফিশারিঘাট লম্বাঘোনা এলাকায় প্যারাবনের ওপর এই নিধনযজ্ঞ চালায় দুর্বৃত্তরা।
অভিযোগ উঠেছে, রাতের আঁধারে এবং প্রকাশ্যে এসব প্যারাবন নিধন করা হলেও উপকূলীয় বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বদরখালী সমিতি বা স্থানীয় প্রশাসন প্যারাবন উজাড়কারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেননি। এতে আরো উৎসাহী হয়ে প্রতিনিয়ত চলছে প্যারাবন নিধনের ঘটনা। পরিবেশ সচেতন স্থানীয় লোকজনের তথ্য এবং ভাষ্যানুযায়ী, ১৯৯১ সালের মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন আঘাত হানে কক্সবাজার উপকূলে। ওই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলায় (পেকুয়াসহ) প্রায় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। হাজার হাজার গবাদিপশুও মারা পড়ে ওই ঘূর্ণিঝড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের সেই রাতে ১৫ থেকে ২০ ফুট ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের কারণে পুরো উপকূল পরিণত হয় বিরানভূমিতে।
তারা জানান, ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী বিরানভূমিতে পরিণত হওয়া চকরিয়া উপকূলের সবুজ বেষ্টনী তৈরিতে কাজ করে জাপানভিত্তিক পরিবেশবাদী এনজিও সংস্থা ওআইএসসিএ (ওয়াইস্কা ইন্টারন্যাশনাল)। এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী প্রতিবছরই জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী এসে বিলুপ্তপ্রায় চকরিয়া সুন্দরবনের জেগে উঠা চরে প্যারাবন সৃজন করেন।
জাপানী সংস্থা ওআইএসসিএ ইন্টারন্যাশনাল এর কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক হামিদুল হক মানিক দৈনিক আজাদীকে জানান, সমুদ্র উপকূলের মোহনা চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় জেগে উঠা চরে প্যারাবন সৃজন কার্যক্রম শুরু করা হয় ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী। সেই থেকে প্রতিবছর এখানে সংস্থাটির পক্ষ থেকে রোপন করা হয় কেওড়া, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্যারাবন। সর্বশেষ দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করায় ২০১৪ সালের পর থেকে জাপানী সংস্থাটি প্যারাবন সৃজন থেকে বিরত থাকেন। ওইপর্যন্ত জাপানী সংস্থাটি এখানে রোপন করে প্রায় ৬০ লক্ষ চারা। একইভাবে দেশীয় এনজিও সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) কর্তৃকও বদরখালী উপকূলে সৃজন করা হয় প্যারাবন।
ওআইএসসিএ’র ব্যবস্থাপক হামিদুল হক মানিক বলেন, ‘উপকূলীয় বদরখালীর লম্বাঘোনা এলাকায় গত কয়েকদিন ধরে যেসব গাছ নিধন করা হয়েছে, এসব গাছ আমাদের সংস্থার রোপিত। বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতির কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই এসব গাছ রোপন করা হয়। বর্তমানে এসব গাছ অনেক বড় সাইজের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে কেটে ফেলা লম্বাঘোনা ১০০ একর চিংড়ি প্রকল্পের লাগোয়া গাছগুলোও অনেক বড় সাইজের ছিল। কিন্তু প্রভাবশালীদের অপতৎপরতার মুখে কিছুই করার নেই।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, বদরখালী সমিতির নিয়ন্ত্রণাধীন লম্বাঘোনা ১০০ একর চিংড়িপ্রকল্প পরিচালনা কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিন লম্বাঘোনা প্রকল্পের পরিধি বাড়াতে কৌশলে প্যারাবনের গাছগুলো কেটে সাবাড় করেছেন। তবে তারা দাবি করেন, কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসিন্দা যারা সমিতির সদস্য তাদেরকে এই লম্বাঘোনা প্রকল্পটি লিজ প্রদান করা হয়েছে। শর্ত ছিল যারা এই ঘোনার উপকারভোগী তারা ঘোনালাগোয়া প্যারাবন গাছগুলো দেখভাল করবে। কিন্তু তা না মেনে রাতের আঁধারে এবং প্রকাশ্যে গাছগুলো কেটে ফেলার খবর পেয়ে বাধা প্রদান করেন।
বদরখালী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রিদুয়ান বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এসব প্যারাবন গাছ দিনের বেলায় প্রকাশ্যে উজাড়ের খবর পেয়ে তিনি বাধা দেন। এ সময় জব্দ করা হয় কেটে ফেলা বেশকিছু গাছ।’
সূত্রগুলো জানায়, লম্বাঘোনা ১০০ একর চিংড়িপ্রকল্প পরিচালনা কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিনের ইন্ধনে লম্বাঘোনার নিলাম গ্রহীতাদের নিয়োজিত কর্মচারী জয়নাল ও জুবাইর প্রকাশ বখতিয়ারের নেতৃত্বে প্যারাবন উজাড় করা হয়। এ সময় শ্রমিক হিসেবে ছিল সরওয়ার, মো. শরীফ, রুহুল কাদের, আবদুল্লাহ, আকতার হোসেন, ফরিদ আলম, রুবেল, বাবুল, আলী আজমসহ আরো বেশকয়েকজন।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক শেখ মোহাম্মদ নাজমুল হুদা চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা অবগত নই। খোঁজ নিয়ে উপকূলীয় বনবিভাগের সাথে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘বদরখালী উপকূলের প্যারাবন উজাড়ের ঘটনায় কাদের ইন্ধন এবং সরাসরি জড়িত রয়েছে তাদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এর পর পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
পাঠকের মতামত: