নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
চকরিয়ায় একসময় তামাক চাষের বিস্তৃতি কমে এলেও চলতি মৌসুমে আবাদ বেড়েছে কয়েকগুণ। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পাশাপাশি তামাকের আগ্রাসন দেখা যাচ্ছে মাতামুহুরী নদীর দুই তীরসহ সরকারি খাস জমিতেও। বাদ পড়েনি কয়েকটি ইউনিয়নের পাহাড়ি টিলা এবং সমতল ভূমিও।
এতে একদিকে বোরো ধান, রবিশস্য, শাক-সবিজসহ রকমারী ফসল খাদ্যশস্য উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি উৎপাদিত তামাক শোধন করতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তামাক চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানোর জন্য সংগ্রহ করা হচ্ছে লাখ লাখ মণ লাকড়ি।
পরিবেশ সচেতন লোকজন বলছেন, মূলত তামাক চাষের পরিধি দিন দিন বাড়তে থাকায় প্রতিবছর এই অবস্থা অব্যাহতভাবে দেখা দিচ্ছে। এতে বর্ষা মৌসুমে ভারি বর্ষণের সময় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির সাথে পলি ও বালু এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে মাতামুহুরী নদী। আর সেই পাহাড়ি ঢলের পানি নদীর দুই তীর উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
সরজমিন চকরিয়া উপজেলার তামাক চাষপ্রবণ কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই তামাকের আবাদ। এসব ইউনিয়নের সিংহভাগ ফসলি জমি গিলে খেয়েছে তামাক চাষ। বিশেষ করে বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলীসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে তামাকের আবাদ হয়েছে এবারও। তন্মধ্যে ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নে। এই তিন ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বহমান মাতামুহুরী নদীর দুই তীর ছাড়াও পাহাড়ি টিলা ও সমতল ভূমির অন্তত ৮০ শতাংশ তামাক চাষের আওতায় রয়েছে। যদিওবা নদীর দুই তীর হচ্ছে সরকারি খাস জমি এবং পাহাড়ি টিলা ও সমতল ভূমি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতাভুক্ত। কিন্তু সেই নদীর তীর, পাহাড়ি ভূমি দখলে নিয়ে এই তামাক চাষ অব্যাহতভাবে চলছে।
তবে উপজেলা কৃষিবিভাগের দেওয়া তথ্যমতে- চকরিয়ার মাত্র পাঁচটি ইউনিয়ন তথা বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী ও লক্ষ্যারচরে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাক চাষ নিয়ে কৃষি বিভাগের এই জরিপে স্থান পায়নি কৈয়ারবিল, বরইতলী, খুটাখালী, চিরিঙ্গাসহ আরো কয়েকটি ইউনিয়ন।
কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় ২২ হাজার হেক্টর আবাদী জমি রয়েছে। তন্মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নে তামাক আবাদ হচ্ছে ৬২০ হেক্টর ফসলি জমিতে। বাকী জমিতে বোরো ধান, রবিশস্য, রকমারী শাক-সবজির উৎপাদন হচ্ছে।
তবে কৃষি বিভাগের এই তথ্য বাস্তবের সাথে অনেক ফাঁরাক রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। তন্মধ্যে তামাকের বিরুদ্ধে দীর্ঘবছর ধরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে তৎপর থাকা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) জরিপ মতে- চকরিয়া উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, মাতামুহুরী নদীর দুই তীর ও পাহাড়ি টিলা ও সমতল ভূমি মিলিয়ে অন্তত দুই হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে পরিবেশ ও মানুষের জীবন ধংসকারী তামাকের।
উবিনীগ কক্সবাজারের সমন্বয়ক মো. জয়নাল আবেদীন খাঁন দৈনিক চকরিয়া নিউজকে বলেন, তামাক চাষের কারণে যেমন জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, তেমনি করে চাষি এবং পরিবার সদস্যসহ আশপাশের মানুষ প্রতিবছর নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তামাক শোধন করতে গিয়ে প্রতিবছর কক্সবাজার ও বান্দরবানের অন্তত ১০ কোটি টাকার কাঠও পোড়ানো হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার তামাক শোধন চুল্লিতে।
অভিযোগ রয়েছে, টোব্যাকো কোম্পানিগুলো ইউনিয়ন ইউনিয়নে তাদের মাঠকর্মীদের দ্বারা নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে প্রান্তিক চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তামাকে চাষের বিপরীতে প্রয়োজনীয় দাদন, সারের জোগান দেওয়ার কারণে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পাশাপাশি পার্বত্য অববাহিকার বিভিন্ন নদীর তীর, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের টিলা ও সমতল বনভূমি দখলে নিয়ে সেখানেও দেদার তামাক উৎপাদন করে যাচ্ছে। অনেক স্থানে বনবিভাগের কার্যালয়ের পাশে সংরক্ষিত বনভূমিতে তামাকের আবাদ হলেও কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম দৈনিক চকরিয়া নিউজকে জানান, দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর ইউনিয়নে তামাকের আগ্রাসন চলছে। ইতোপূর্বে তামাক চাষিদের নিয়ে এলাকায় এলাকায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে প্রান্তিক চাষিরা তামাক চাষ অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, যদি তামাক চাষ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা না হয় তাহলে, এই অবস্থা অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে।
একই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুরুল কাদের, কাকারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সাহাব উদ্দিনসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা।
তামাক চাষিরা জানান, জ্বালানী হিসেবে চুল্লিতে লাকড়ি বা কাঠ ছাড়া তামাক পেড়ানো হলে ভাল গ্রেড পাওয়া যায় না। তাই বেশি মূল্য পেতে গ্রেডের মান নিশ্চিত করতে অবশ্যই কাঠ পোড়াতে হয়। প্রতি মৌসুমে একেকটি চুল্লিতে অন্তত ৪০ হাজার কেজি তামাক শোধন করা যায়। বিপরীতে প্রতি চুল্লিতে ওই পরিমাণ তামাক শোধনে কাঠ পোড়াতে হয় অন্তত সাড়ে তিন লাখ কেজি। আর সেই জ্বালানীর ৮০ শতাংশ সংগ্রহ করতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে। অপরদিকে চুল্লি নির্মাণের সময় প্রতিটিতে ২০-২৫ ফুট লম্বা প্রায় ৩০টি খুঁটি ব্যবহার করা হয়। এসব খুঁটিও সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করতে হয়। ব্যবহৃত খুঁটির মধ্যে রয়েছে সেগুন, গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
চাষিরা জানিয়েছেন, একই জমিতে বারবার তামাক চাষের কারণে জমির উর্বরতা শক্তিও দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ ভাল মানের তামাক উৎপাদন করতে হলে ব্যাপকহারে সার-কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় জমিতে।
চকরিয়ায় তামাক চাষ নিয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাছিম হোসেন দৈনিক চকরিয়া নিউজকে বলেন, তামাক চাষ বন্ধ করার বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন বিধি-নিষেধ নেই। তবে তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করে রকমারী ফসলের আবাদে ফেরাতে প্রান্তিক কৃষকদের প্রতিনিয়ত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার যদি তামাক চাষ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় তাহলেই সম্ভব হবে তামাক চাষ রোধ করা।
কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এরপরেও তামাক চাষের কুফল ও ভয়াবহতার কথা অনুধাবন করে প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে নিতে পারে সরকার। মূলত চাষিরা সচেতন হলেই বিকল্প ফসল উৎপাদনের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। তা করা না হলে দিন দিন আবাদি জমি কমে গেলে নিরাপদ খাদ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলায় বড় ধরণের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে।
পাঠকের মতামত: