নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
কাগজে-কলমে সংরক্ষিতই বটে কক্সবাজারের ডুলাহাজারা বনাঞ্চল। কিন্তু চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কের দু’পাশের এই বনভূমির মালুমঘাট অংশে গেলেই চমকে উঠতে হয়। মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান মিশনারিজ হাসপাতালের পাশ দিয়ে যেতে চোখে পড়ে, বনজুড়ে গড়ে উঠেছে একটি ছোট শহর। সেখানে ডুলাহাজার বিট কর্মকর্তার রহস্যজনক নিরব ভুমিকায় সংরক্ষিত বনের সেগুন, গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে নির্মাণ করা হয়েছে কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, দোকানপাট, এমনকি বাণিজ্যিক স্থাপনাও। গড়ে উঠেছে মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, এমনকি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়। বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হয়েছে এই শহরে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলছেন, বনভূমির দখলদারদের ৮০ ভাগই জনপ্রতিনিধি। বন বিভাগেরই একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় তারা এসব দখল করে রেখেছেন। বেদখল ভূমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি দখলকারীদের একটি তালিকা করতে বন বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান উপমন্ত্রী।
শুধু ডুলাহাজারা বনবিট মালুমঘাটের নয়: স্থানীয় হাছিনাপাড়া, ছগিরশাহ কাটা, রংমহল ডোমখালীতেও দেখা গেছে প্রায় অভিন্ন চিত্র। ডুলাহাজারা বনবিট ছাড়াও বন বিভাগের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের আওতায় আরও চারটি বনবিট রয়েছে। এগুলো হলো- রিংভং, কাকারা, নলভিলা ও মানিকপুর বনাঞ্চল। এর মধ্যে হাতির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত রিংভং বনবিটের উচিতার বিল, ছায়রাখালী ও অফিসপাড়া, নলবিলা বনবিটের ইসলামনগর ও বার আউলিয়া নগর, কাকারা বনবিটের শাহ ওমরনগর, পুলেরছড়া পাহাড়তলী শাহ ওমর মজারসংলগ্ন নরসিঙ্গা পাহাড়, পাহাড়তলী, মানিকপুর বিটের উত্তর মানিকপুর, ফাইতং এবং পূর্ব সুরেশপুরের শান্তিপুর এলাকাও ভরে গেছে ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনায়।
চকরিয়ার পাঁচটি বনাঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছেন কক্সবাজার বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। তিনি চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘বহু আগে থেকেই বনের জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। দখলবাজরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, অনেকেই জনপ্রতিনিধি। তাই চাইলেও অনেক সময় কোনো কথা বলা যায় না। তবে এখন আর নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে দেওয়া হচ্ছে না।’ টাকার বিনিময়ে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
ছোট শহর ‘মালুমঘাট’: ডুলাহাজারা এলাকায় মালুমঘাটে সড়কের পূর্ব পাশে গড়ে উঠেছে মালুমঘাট বাজার। এর বেশিরভাগ দোকানপাটই পাকা। বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনও রয়েছে এখানে। রয়েছে চা-সিগারেটের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় মুদি দোকান, টাইলস-বেসিন, ক্রোকারিজ ও রড-সিমেন্টের দোকান। মালুমঘাট বাজার কমিটির দেওয়া হিসাবমতে, শুধু এই বাজারেই রয়েছে অন্তত ৫৫০ থেকে ৬০০ দোকানপাট ও বাণিজ্যিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই বাজারে নতুন নতুন দোকানপাট নির্মাণ করা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন ডুলাহাজারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আহসানুল ইসলাম আদর।
মালুমঘাট বাজারের সভাপতি মনজুর আলম বলেন, ‘মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতাল হওয়ার পর থেকে মালুমঘাটে লোকজন বসতি গড়ে তুলতে থাকে। তবে ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে সরকারিভাবে বাজারটি অনুমোদন দেওয়া হয়। বন বিভাগ ও আমরা মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি, যাতে আর কোনো বনের জায়গা বেদখল না হয়। নানা কারণে তা পারা যায় না।’
বনের মধ্যে বস্তি: মালুমঘাট বাজারের পশ্চিম পাশে বনের ভেতরে বহু ঝুপড়িঘর। জায়গার নাম হাছিনাপাড়া। লোকজন জানান, বন বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে সমঝোতা করে এসব ঘর বানিয়েছেন তারা।
ডুলাহাজারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর জানান, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় পুরোটাই পড়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। ২, ৩, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বড় একটি অংশও এই বনাঞ্চলের। ইউনিয়নের ৩০-৩৫ হাজার মানুষ বনভূমির এলাকায় ঘরবাড়ি তুলে বসবাস করছে।
কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা ১৭৬০ সালে আরাকান রাজ্যে যাওয়ার পথে অনেক ডুলি (মূলত মোগল নারীদের বাহন) নিয়ে যাওয়ার সময় এখানে ক্যাম্প করেন। তাই এই এলাকার নাম হয়ে যায় ডুলিহাজরা, যা পরে ‘ডুলাহাজারা’ হয়ে যায়। এ বনাঞ্চলে রয়েছে হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাস ও চলাচলের করিডোর।
আগর বাগানে ইট-কংক্রিট: ডুলাহাজারা মালুমঘাট বাজারের পূর্ব পাশে বনবিটের আগর বাগান। চৈত্রের ভরদুপুরে সবুজ সেই বাগান থেকে যেন চোখ ধাঁধানো লাল রঙের ঝলকানি বের হচ্ছিল। সেখানে প্রায় এক একর বনভূমি দখল করে ও আগরগাছ কেটে ফেলে তৈরি করা হয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র। এখানকার ইট-কংক্রিটের ব্যবসায়ী মো. সেলিম জানালেন, বেশ ক’বছর ধরে এখানে ইট-কংক্রিটের ব্যবসা করছেন তিনি। বন বিভাগের কর্মীদের নিয়মিত নজরানা দিতে হচ্ছে।
স্ট্যাম্পে বনভূমি বেচাকেনা: বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। এই রেললাইন স্থাপনের জন্য চকরিয়ার বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের রিংভং বনবিটের ছগিরশাহ কাটা এলাকা থেকে বেশকিছু পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। তারা এখন বসতি গড়ে তুলেছেন বনের আরও ভেতরে। ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ছগিরশাহ কাটা গ্রামটি এভাবে গড়ে উঠেছে সংরক্ষিত বনভূমিতে।
ছগিরশাহ কাটা গ্রামে কথা হয় চায়ের দোকানদার আবুল হাশেমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এখানে ঘরবাড়ি কিংবা দোকানপাট নির্মাণ করা কঠিন কিছু নয়। তবে এ জন্য বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করতে হয়। একই দোকানে কথা হয় পাশের রাইস মিলের কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, বনে গড়ে ওঠা গ্রামের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট স্ট্যাম্পের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকায় নিয়মিত হাতবদলও হয়ে থাকে।
হাতির অভয়ারণ্যে ইটের ভাটা: ফাঁসিয়াখালী রেঞ্চের রিংভং বনবিটের উচিতার বিলে রয়েছে হাতি চলাচলের করিডোর। এখানে গিয়ে দেখা গেছে, করিডোরটি দখল করে গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা! জেএমবি নামে এই ইটভাটার মালিক চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘চকরিয়ায় ১৮টি ইটভাটা রয়েছে। আমার ইটভাটা যেখানে, সেখানে হাতির কোনো করিডোর নেই। আর আমার ইটভাটা পরিবেশদূষণ করলে অন্যগুলো কি করছে না?’
পাঠকের মতামত: