ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়াসহ জেলায় বেপরোয় সাড়ে ৩শ’ কেজি স্কুল, মানছেনা কোন নির্দেশনা

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার :: নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতেই বিভিন্ন প্রকাশনার লোকজনের দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়ে গেছে। চলছে কিন্ডার গার্টেন স্কুলসমুহের প্রধানদের সাথে মোটা অংকের দর কষাকষি। যারা বেশি টাকা দিচ্ছে তাদের বইয়ের মান যাই হোক তাদের বই পাঠ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করছে এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ। বিভিন্ন প্রকাশনার লোকজন তাদের প্রকাশিত বই ক্লাসে পড়ানোর জন্য স্কুলে স্কুলে বিশেষ ‘ডোনেশন নামে মোটা টাকা ব্যবহার করছে। টাকা পেয়ে এ সব স্কুলে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে নিম্নমানের বই যা সারা বছর জুড়ে কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের পড়ানো হবে। ফলে জেলার সাডে তিন শতাধিক কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিশুদের বোর্ড বইয়ের বাইরে দেয়া হচ্ছে এসব বই। সরকার যেখানে শিশুদের উপর মানসিক চাপ কমানোর জন্য পরীক্ষা, বই, সিলেবাস কমানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সেখানে কিন্ডারগার্টেন স্কুলসমুহ অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা ছাপিয়ে দিচ্ছে প্রকাশকদের কাছ থেকে ‘বিশেষ ডোনেশন’ গ্রহণ করে। যেখানে প্রশাসনের কোন নজরদারি চোখে পড়ছে না। যে স্কুলে শিক্ষার্থী যত বেশি সে স্কুলের ডোনেশনের চাহিদা বেশি যা কয়েকজন প্রকাশনার এরিয়া ম্যানেজার প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমুহে যেখানে বোর্ড নির্ধারিত পাঠ্যবই পড়িয়ে ভাল ফলাফল করছে সেখানে কিন্ডার গার্টেনসমুহে পড়ানো হচ্ছে বোর্ড বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত ৫/৬ টি বই। ফলে শিক্ষার্থীরা কুঁজো হচ্ছে বইয়ের ভারে। ক্ষতির শিকার হচ্ছে আর্থিক, মানসিক এবং শারীরিক। সরকার বোর্ড নির্ধারিত বই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নির্দেশ প্রধান করলেও কোন কিন্ডার গার্টেন সেই নীতিমালা তোয়াক্কা করছেনা। ফলে টাকার লোভে অতিরিক্ত বই ছাপিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন বিষিয়ে তুলছে। শিশুদের বাড়ছে স্কুলভীতি এবং বইভীতি।
এদিকে শহরের নাম করা কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ঘুরে দেখা যায় প্রথম শ্রেণিতে ৭টি বই দেয়া হচ্ছে কচি শিক্ষার্থীদের। সরকারি বিনামূল্যের ৩টি বোর্ড বই বাংলা, গণিত এবং ইংরেজি দেওয়ার পর একটি তালিকা ধরিয়ে দিয়ে স্কুল থেকে বলা হয় বাকি ৪টি বই ‘অমুক’ লাইব্রেরি থেকে কিনতে হবে। অমুক বই এর মধ্যে একটিভ ইংলিশ, ওর্য়াড বুক, ড্রইং বই, কম্পিউটার বই রয়েছে একজন ৬ বছরের শিশুর কাঁধে ৭টি বই, পেন্সিল বক্স, পানির বোতল, টিফিনবক্সসহ নানা সরঞ্জাম প্রমান করে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের অবস্থা। তারা কি লেখাপড়া শিখবে নাকি ভয়ে স্কুল পালাবে এমন অবস্থা। শুধুমাত্র প্রকাশনার দেয়া ডোনেশন জায়েজ করতে ছোট্ট শিশুকে মানসিক বিকারের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অমান্য করে শুধু শহরের কিন্ডার গার্টেন স্কুল নয় জেলার প্রায় সাড়ে ৩’শ কেজি স্কুলে এভাবে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের উপর ছাপানো হচ্ছে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা। বইয়ের অতিরিক্ত বোঝার কারনে শিক্ষার্থীরা যেমন স্কুল বিমুখ হচ্ছে তেমনি নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক কারনে শিক্ষাকে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকরণের কারনে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের উপর প্রতিবছর বাড়ছে বইয়ের বোঝা। ন্যাশনাল টেক্সট ক্যারিকুলাম বুক বোর্ডের বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ৩টি বই এবং তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য ৬টি বই সিলোবাসভুক্ত করে পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভূক্ত করেছে। যা চলমান রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমুহে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেন স্কুল সমুহে র্বোড বই এর পাশাপাশি লাইব্রেরীর মালিকদের সাথে মোটা অংকের চুক্তির বিনিময়ে শিশুদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা। ফলে শিক্ষার্থীর ধারন ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে শিখন শিক্ষণ। শুধুমাত্র লাইব্রেরির মালিক এবং পুস্তক ব্যবসায়ি সমিতির নেতাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে জেলার নামকরা কিন্ডার গার্টেনের অধ্যক্ষ, শিক্ষক এবং পরিচালনা কমিটি। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে লাইব্রেরির মালিকগণ পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে র্ধণা দেয় কেজি স্কুলের অধ্যক্ষদের কাছে। অনেক স্কুলের অধ্যক্ষগণ দর কষাকষির মাধ্যমে লাইব্রেরির মালিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভূক্ত করে এ সব অখ্যাত প্রকাশনার অতিরিক্ত বই। শুধুমাত্র অতিরিক্ত টাকার লোভে শিক্ষাকে ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য বিনষ্টকারিদের বিষয়ে সচেতন হওয়া সময়ের দাবি।

বোর্ড প্রণীত পাঠ্যবই ব্যতিত অতিরিক্ত বিভিন্ন প্রকাশনার বই কতটুকু শিক্ষার্থীর জন্য জরুরি এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফজলুল করিম চৌধুরী বলেন সরকার অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করে শিক্ষা বিশারদ নিয়ে প্যানেল করে বোর্ড বই প্রণয়ন করেছেন। সুতরাং প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য ৩টি বই যথার্থ। এর বেশি বই কোনমতেই প্রযোজ্য নয়। ৬ বছরের শিশু শিক্ষার্থীকে তো মেরে ফেলতে পারবেন না। যদি তা করা হয় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। সরকার শিশুর ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ি বোর্ড বইগুলো পাঠে অর্ন্তভূক্ত করে থাকেন। ফলে অতিরিক্ত বই ছাপিয়ে দিয়ে শিশুকে মানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে অভিভাবকগণকে সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে কোমলমনে তার কি প্রভাব পড়ে। আমি মনে করি বোর্ড বই এর বাইরে কোন বই পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করা কোন মতেই উচিত নয়। এ ব্যাপারে কিন্ডার গার্টেন সমিতি আছে , শিক্ষা প্রশাসন আছে তাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। তিনি বলেন পৃথিবীর কোন দেশে শিশু শিক্ষার্থীদের এত মানসিক চাপের মুখে ঠেলে দেয়া হয় কিনা আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
সরকারি বোর্ড বইয়ের বাইরে অন্য কোন বই পড়ানোর ব্যাপারে কোন নির্দেশনা আছে কিনা এবং তা শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে জানতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ শফিউল আলম এর কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে কোন সরকারি, বেসরকারি, স্বায়িত্বশাসিত স্কুল বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন স্কুলসমুহে বোর্ড বই ছাড়া অন্যকোন বই পড়ানো যাবেনা।

এ ব্যাপারে প্রতিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে কোন বিদ্যালয়ে বোর্ড বই ব্যতিত অন্যকোন বই সিলেবাসভুক্ত করে পড়ানো না হয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কোন মতেই অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপানো যাবেনা ।

চকরিয়া পেৌর সদরের ২নং ওয়ার্ডের নাম করা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্টানে সরকারী পাঠ্যবই দেয়ার সাথে অপরাপর আরো কয়েকটি বই দিয়ে প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০৭০টাকা করে আদায় করা বলে ব্যাপকহারে অভিযোগ উঠেছে।

চকরিয়া গ্রামার স্কুলের একজন ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রীকে পাঠ্য বই দেয়ার সময় ২৮শত টাকার ভর্তি ফি ছাড়াও অতিরিক্ত আরো ১০৭০টাকা আদায়ের জানতে চাইলে বিদ্যারয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ওই টাকা পাঠ্যবই ছাড়াও অন্যান্য বই ও ডায়রী বাবত নেওয়া হচ্ছে।এভাবে চকরিয়ায় অবস্থিত খ্যাত-অখ্যাত প্রায় শতাধিক কিন্ডার গার্ডেন, কেজি স্কুল ও এমপিও ভুক্ত বিদ্যালয়গুলো এ অবস্থা বিরাজ থাকলেও প্রশাসনের কোন প্রকার মাথা ব্যথা নেই বললেও চলে।

কতিপয় শিক্ষা ব্যবসায়ি এবং অসাধু লাইব্রেরির মালিকদের আর্থিক লোভের কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বলি হচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত বই ছাড়া অতিরিক্ত বই চাপিয়ে দেওয়া স্কুল সমুহ চিহ্নিত করে চলতি মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কালক্ষেপণ হলে চরম ক্ষতির সম্মুখিন হবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকগণ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তড়িৎ হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতন মহল।

পাঠকের মতামত: