ঢাকা,মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ার পুতুলের বিশ্বজয়

putulউঠোনে বসে ঘরের বৌ-ঝিদের এভাবে পুতুল তৈরির দৃশ্য চোখে পড়বে চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :::

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে চকরিয়ার নারীদের হাতে তৈরি পুতুল জয় করেছে বিশ্ব। এসব পুতুল অন্তত ৩৬ দেশে বাজারজাত হচ্ছে। ‘হাতে বুনন’ নামের ঢাকার একটি কম্পানি এগুলো কিনে নেয়। পরে এরা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। বিশ্বজয়ী পুতুলগুলো তৈরি হচ্ছে কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে।

খুটাখালীর উত্তর মেধাকচ্ছপিয়া গ্রামের স্বামীহারা জয়গুন নাহার (৪৫) কালের কণ্ঠকে জানান, তিনিসহ প্রায় ২০ জন নারী হাতে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের পুতুল। হাতের কারসাজিতে তৈরি হচ্ছে অক্টোপাস রেটল, কাউবয় রেটল, প্লেইন রেটল, মারমিড রেটল, মানকি রেটল, পেঙ্গুইন, পাণ্ডা, ফ্লাওয়ার, হোয়াইট বল, আপেল, অরেঞ্জ, ক্যারট, পিপজি, ড্রাগন ফ্রুট, বানি মালছি, ফ্রগ বয় প্রভৃতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বের ৩৬টি দেশে বর্তমানে এসব পুতুল রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশের তালিকায় রয়েছে আমেরিকা, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, সুইডেন অন্যতম। এসব দেশে বেশি চাহিদা রয়েছে হাতে তৈরি এসব পুতুলের।

সমপ্রতি কথা হয় জয়গুন নাহার এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে। জয়গুন নাহার বলেন, ‘তিন ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে স্বামী মারা যায়। এর পর দীর্ঘ ১৮ বছর পর্যন্ত পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে গিয়ে বনের গাছ কাটাসহ কত কিছুই না করতে হয়েছে আমাকে। এই অবস্থায় ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইকোসিস্টেম অ্যান্ড লাইভিহুড (ক্রেল) নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় হস্তশিল্পের। প্রায় দুই মাস একনাগাড়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আর বনের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়নি আমাদের। দীর্ঘ আড়াই বছর পর্যন্ত আমরা নিজেরাই হাতে তৈরি করছি বিভিন্ন ধরনের পুতুল। ’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রশিক্ষণ পেয়ে আমরা যখন বিভিন্ন ধরনের পুতুল হাতে তৈরি করি, তখন দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এখন শুনছি, আমাদের হাতে তৈরি পুতুল বিশ্বের বড় বড় দেশে পাঠানো হচ্ছে। আমাদের তৈরি পুতুল বিদেশে যাচ্ছে, এটি শোনার পর থেকে কি যে খুশি লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না! কেননা কোনোদিন চিন্তাও করিনি, আমাদের হাতে তৈরি পুতুল বিশ্বজয় করবে। ’

জয়গুন নাহারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন একই এলাকার মোস্তফা বেগম, ছেনুয়ারা বেগম, রোহানা বেগম, বুলবুল, রোকেয়া বেগম, তাহেরা বেগম, খুরশিদা বেগম, রুনা আক্তার, জয়নাব বেগম, রাজিয়া সুলতানা, শাহিনা আক্তার, সেতারা বেগম, রোকেয়া, রোকসানা বেগম, মোহছেনা বেগম, ছাবেকুন্নাহার, জেবুন্নাহার, আনার কলি ও রেনু বেগম।

তাঁরা জানান, তাঁদের কারো স্বামী মারা গেছেন, আবার কেউ তালাকপ্রাপ্তা। এই অবস্থায় বাড়ির কাছের মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক) এলাকা থেকে বনের গাছকাটা, লাকড়ি সংগ্রহ ছিল সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন। যদিওবা বনের গাছকাটা নিয়ে প্রতিনিয়ত বনবিভাগ তাঁদের তাড়া করত। অনেক সময় মামলার আসামিও হতে হয়েছিল অনেককে।

তাঁরা বলেন, বছর তিনেক আগে আমাদেরকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন ক্রেল প্রকল্পের সাইট অফিসার আবদুল কাইয়ুম। একদিন তিনি আমাদেরকে একত্রিত করে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন, ‘বনের গাছ কাটলে একদিকে পরিবেশের ক্ষতি, অন্যদিকে মামলা-হামলার ভয় রয়েছে। ’

তাহলে কীভাবে সংসার চলবে-এমন প্রশ্নের উত্তরে আবদুল কাইয়ুম আশ্বাস দেন, ‘বনের গাছ কেটে এখন থেকে আর আপনাদের সংসার চালাতে হবে না। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে হস্তশিল্পের। ’

তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে নবউদ্যমে নেমে পড়েন সবাই হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণে। এতে সফলতাও এসেছে দ্রুত। এখন আর বনের গাছ কেটে সংসার চালাতে হচ্ছে না।

তাঁরা জানান, হাতের কারসাজিতে খেলনা পুতুল তৈরি করে একেকজন নারী প্রতিমাসে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা আয় করছেন। পুতুল তৈরির জন্য ঢাকার ‘হাতে বুনন’ নামের একটি কম্পানি রসদ (সূতা, ফোম, লিকার) সরবরাহ করেন। বিনিময়ে মজুরি হিসেবে একেকটি পুতুল তৈরিতে পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ১২০ টাকা, থেকে সর্বনিম্ন ১৫ টাকা। এভাবেই হাতে তৈরি পুতুলের মজুরি দিয়ে ভালোই চলছে সবার সংসার। তবে তাদের মজুরি সময়মতো যাতে পান সেজন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ রেখেছেন জীবনসংগ্রামী এসব নারী।

ক্রেল প্রকল্পের চকরিয়ার সাইট অফিসার মো. আবুদল কাইয়ুম জানান, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী ও খুটাখালীর মেধাকচ্ছপিয়ার পৃথক জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল নির্ভর জীবিকা ছিল কয়েক হাজার মানুষের। এতে বিগত সময়ে তারা বনের গাছকাটা, লাকড়ি সংগ্রহসহ বনাঞ্চল উজাড় করে সংসার চালাতো। ক্রেল প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদেরকে বনরক্ষায় যথাযথ উদ্বুদ্ধকরণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ায় প্রায় ৩ হাজার ৫০০ পরিবার বনের গাছকাটা তো দূরের কথা, তারাই এখন বনরক্ষায় কাজ করছে।

‘এ জন্য তাঁদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে স্বামীহারা ও তালাকপ্রাপ্তা বেশ কয়েকজন নারীর হাতে তৈরি বিভিন্ন আইটেমের খেলনা পুতুল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজয় করে নিয়েছে। বর্তমানে অন্তত ৩৬টি দেশে এসব খেলনা পুতুল বাজারজাত হচ্ছে। এর আগে প্রশিক্ষণ দিয়ে ঢাকার হাতে বুনন নামে একটি কম্পানির সঙ্গে তাঁদের সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। যা একটি সফল দৃষ্টান্ত এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলে মনে করি। ’-যোগ করেন আবদুল কাইয়ুম।

তিনি জানান, বননির্ভর এসব পরিবারকে স্বাবলম্বী করে ফাঁসিয়াখালী ও মেধাকচ্ছপিয়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে একটি শক্তিশালী ও টেকসই সংগঠন হিসেবে দাঁড় করিয়ে বন, পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্যকে রক্ষায় প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ক্রেল প্রকল্প।

আবদুল কাইয়ুম জানান, ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইকোসিস্টেম অ্যান্ড লাইভিহুড (ক্রেল) নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব নারী স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। ইউএসএআইডির অর্থায়নে এবং উইনরক ইন্টারন্যাশনাল এর কারিগরি সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ মাঠপর্যায়ে সরাসরি তদারকি করছেন ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) ও কোডেক। বাংলাদেশ সরকারের চারটি মন্ত্রণালয় যথাক্রমে পরিবেশ ও বন, মত্স্য ও কৃষি, ভূমি এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দেশের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলাভূমি, সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষায় সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গত ২০ বছর ধরে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।

পাঠকের মতামত: