ঢাকা,সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

কিন্ডারগার্টেনের প্রধানরা সবাই অধ্যক্ষ! বিব্রত কলেজের অধ্যক্ষরা

নিজস্ব ডেস্ক ::

চট্টগ্রামে কিন্ডারগার্টেনের প্রধানরা হরহামেশা নিজেদের অধ্যক্ষ বলে পরিচয় দিচ্ছেন। যদিও নিয়ম রয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অধ্যক্ষ পদ ব্যবহার করতে পারবেন না। কিন্তু এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষাসংক্রান্ত অন্য কোনো সংস্থার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধানরা নিজ প্রতিষ্ঠানে যেমন, বাইরেও অধ্যক্ষ পদ ব্যবহার করছেন। আর স্বঘোষিত এসব অধ্যক্ষের ভিড়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষরা রয়েছেন এক বিব্রতকর অবস্থায়।

চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠেছে শত শত কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এসব স্কুলের বেশির ভাগ বিভিন্ন বাসাবাড়ি ভাড়া করে পরিচালিত হচ্ছে। অনেকগুলোতে ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ সাইনবোর্ড লাগানো থাকলেও নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া হয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া হলেও শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদিত নয়। তারা ছাত্রছাত্রীদের নবম ও দশম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনের জন্য বিভিন্ন এমপিওভুক্ত স্কুলের শরণাপন্ন হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে এ ধরনের কত স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে নেই।

এসব প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মোহাম্মদ সুলতান মিয়া বলেন, ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান অধ্যক্ষ লিখতে পারেন না। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা তো প্রশ্নই আসে না। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি না মানে তা হলে আমরা কিছু করতে পারি না। কারণ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর কেবল তাদের পাঠদানের অনুমতি প্রদান ও রেজিস্ট্রেশনের সময় কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকে। পরে যদি প্রাথমিক স্তরের এসব পাঠদান প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রধান স্বঘোষিতভাবে অধ্যক্ষ বা প্রিন্সিপাল ব্যবহার করেন তা তার নীতি-নৈতিকতার বিষয়। এটা নিয়ে আমাদের করার কিছুই থাকে না।’

কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধানদের অধ্যক্ষ পদবি ব্যবহার নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক বর্তমানে মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা দপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মুহাম্মদ আজিজ উদ্দিন বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান প্রধান কোনোভাবেই অধ্যক্ষ পদবি ব্যবহার করতে পারেন না।’ তিনি জানান, এ ধরনের একটি বিষয় নিয়ে ২০১৬ সালে সরকার একটি পরিপত্র জারি করেছিল। ওই পরিপত্রে সরকারের মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের প্রতি একটি নির্দেশনা রয়েছে।’

চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর সাহেদা ইসলাম বলেন, ‘পাঠদান নীতিমালা অনুযায়ী প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ অধ্যক্ষ পদপদবি ব্যবহার করতে পারবে না। বর্তমান সময়ে এসব বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে।” তিনি বলেন, প্রাথমিক স্তরের পাঠদান প্রতিষ্ঠান প্রধান অধ্যক্ষ বা প্রিন্সিপাল পদবি ব্যবহার করা এক ধরনের অপব্যবহার। এসব বিষয় প্রশাসনের দেখার কথা। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে ২৫৯টি। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর সাহেদা ইসলাম জানান, একাদশ শ্রেণি পাঠদানকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অধ্যক্ষ বা প্রিন্সিপাল পদবি ব্যবহার করতে পারেন। চট্টগ্রামে অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানো হয় এমন খ্যাতিমান দুটি কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে চাইলে প্রসঙ্গটি বিব্রতকর উল্লেখ করে কিছু বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে তাঁরা বলেন, বিষয়টি মনিটরিং করার দায়িত্ব সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০-১৫ বছর শিক্ষকতা করে অভিজ্ঞা অর্জনের পর একজন শিক্ষক অধ্যক্ষ হতে পারেন। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনের প্রধানরা এই পদবি অনায়াসে ব্যবহার করছেন। এসব কিন্ডারগার্টেনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি ক্ষেত্রবিশেষে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদবি হওয়ার কথা প্রধান শিক্ষক বা পরিচালক। কিন্তু তারা অনায়াসে অধ্যক্ষ লিখছেন।

চট্টগ্রামের খ্যাতনামা একটি সরকারি কলেজে শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল ব্যবস্থার প্রচার ও প্রসার শুরু হয় মূলত ’৭৫ পরবর্তী সময়ে। সত্তর দশকে শেষ ও আশির দশকের শুরুর দিকে জামায়াত রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই কিন্ডারগার্টেন স্কুল কার্যক্রম ব্যাপক আকারে চালু করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা নিজেদের নামের আগে অধ্যক্ষ পদবি ব্যবহার শুরু করেন। সেই সময় এসব কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষরা সরাসরি জামায়াত ইসলামীর বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্বশীল হিসেবে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। নামের আগে অধ্যক্ষ বা প্রিন্সিপাল থাকায় সমাজে সাধারণ মানুষ তাঁদের ব্যাপারে একধরনের ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করত। তিনি জানান, শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশে কিন্ডারগার্টেনের বিস্তারে জামায়াত সংশ্লিষ্টরা যুক্ত।

চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলায় একটি কিন্ডাগার্টেনের ‘অধ্যক্ষ’ মিন্টু সিকদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, প্রাথমিক স্তরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে আপনি কিভাবে অধ্যক্ষ পদবি ব্যবহার করছেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই লিখছে, তাই আমিও লিখছি।’ চট্টগ্রাম কিন্ডারগার্টেন ঐক্যপরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিভাগে প্রায় ছয় হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। আর চট্টগ্রাম মহানগরে ৯০০-সহ চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে দুই হাজার ২০০। ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেনের ট্রাডিশন হচ্ছে প্রিন্সিপাল বা অধ্যক্ষ পদবি ব্যবহার করা।’ আরো দু-একটি বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ডিসি অফিসে মিটিং রয়েছে উল্লেখ করে পরে কথা হবে বলে টেলিফোন রেখে দেন।

পাঠকের মতামত: