এম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার, ৯ এপ্রিল ॥
কক্সবাজারের উপকুলীয় এলাকা মহেশখালীর মাতারবাড়ী, টেকনাফ, পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার সদর এলাকার শতাধিক গ্রামের দেড় লক্ষাধিক মানুষ শুক্রবার থেকে অসময়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় টিয়াকাটি, রোস্তমদোনা ও রাঙ্গাখালির প্রায় এক কিলোমিটার ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে লোকালয়ে অমাবশ্যার জোয়ারের পানি ঢুকে আট গ্রামে নিম্নাঞ্চল সব চেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে। এতে জোয়ারের পানিতে শুধু ওই এলাকায়ই তালিয়ে গেছে প্রায় ৮‘শ একরের লবণ মাঠ ও ৪’শ একরের বোরো ধান। ভেঙ্গে গেছে দক্ষিণ মগডেইল, সাইরার ডেইল, মাইজপাড়া, বিলপাড়া, ফুলজানমোরা, দক্ষিণরাজঘাটের অন্তত এক’শ কাচা ঘরবাড়ি। শাহপরীর দ্বীপের ৭/৮ গ্রামে অমাবশ্যা জোয়ারের পানি রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এতে লোকালয়ে ডুকে পড়েছে সাগরের পানি।
জানা যায়, জেলার উপকুলের বেড়িবাঁধের ভাঙ্গনদশা বহু বছরের। গত বছরও বহু সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে জোয়ারের পানি আর বর্ষা মৌসুমে বন্যায়। অসংখ্য মানুষ হারিয়েছে ঘর। ভিটেমাটি হারিয়েছে, হারিয়েছে বহু আপনজন। কিন্তু প্রতি বছর কক্সবাজার উপকুলের মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হলেও সেই পুরনো ভগ্ন বেড়িবাঁধই রয়ে গেছে এখনো। ভাঙ্গা অংশের কিছুটা জোড়াতালি দেয়া হলেও জেলার ১১ লাখ মানুষ এবং তাদের সম্পদ রক্ষার মতো টেসই বাঁধের পূণঃনির্মাণ হয়নি। ফলে বর্ষা শুরুর আগেই আতঙ্ক বাড়ছে উপকুল জুড়ে।
এদিকে, একই ভাবে বিধবস্ত বেড়িবাঁধের কারণে আতঙ্কে দিন কাটছেন পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর ও মহেশখালী উপজেলার ৬৪ গ্রামের মানুষের। এখানেও শুক্রবার থেকে অমাবশ্যার জোয়ারের প্রভাবে বহু গ্রামে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গত বছর সদর উপজেলার খুরুশকুল, চৌফলদন্ডীর ভারুয়াখলীসহ শহরের মাঝিরঘাট ও পেশকার পাড়ায় প্রায় সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে কয়েক’শ ঘর-বাড়ী প্লাবিত হয়। এ বছরও ঝুঁকির মুখে উপকূলের হাজারো মানুষ।
টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান নুর হোছাইন বলেন, ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় শাহপরীর দ্বীপের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ উদ্বিগ্ন। ঘর-বাড়ী হারিয়ে অনেকে টেকনাফ সদরে আশ্রয় নিচ্ছে। ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় বিলীন হওয়া ৫ কিলোমিটার সড়কও তৈরি
রামু রশিদ নগর এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান মিজান বলেন, রামু উপজেলার রশিদনগর, জোয়ারিয়ানালা, হাইটুপি, মিস্ত্রিপাড়া ও মুক্তারকূল গ্রামে প্রায় ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ১৮টি গ্রাম ঝুঁকির মুখে রয়েছে। জোয়ারের সময় এসব গ্রামে হাঁটুপানি জমে থাকছে।
রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম বলেন, ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য আবেদন করেও পাউবো’র কোন সাড়া মিলছে না। ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করা না হলে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ আবারও পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাবে।
একইভাবে পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া, কাকপাড়া, শরৎঘোনা ও রাজাখালী; মহেশখালী উপজেলার হামিদখালী, টিয়াকাটি, সাপমারার ডেইল, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা, চকরিয়া উপজেলার কন্যারকুম, নাপিতখালী, পুরুত্যাখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবরডেইল, উত্তর ধুরুং ও দক্ষিণ ধুরুংয়ের অন্তত ৪৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান জানান, উপকূলে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙ্গা। জেলায় বেড়িবাঁধ রয়ে গেছে ৫৯৫ কিলোমিটার। গত বছর ৩১ জুলাই ঘূর্ণিঝড় কোমেন ও পূর্ণিমার জোয়ারের আঘাতে জেলার টেকনাফ, পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর ও মহেশখালী উপজেলায় প্রায় ৮২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিধবস্ত হয়। আংশিক বিধিবস্ত হয় আরো ১৫৮ কিলোমিটার বেড়িবাধঁ। এখন জোয়ারের ধাক্কায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধগুলোও ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতে করে ঝুঁকির মুখে পড়ছে উপকূলের প্রায় ১১ লাখ মানুষ।
তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ও পূর্ণিমার জোয়ারে জেলায় ক্ষতিগ্রস্থ ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য ১৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলে বিধবস্ত বেড়িবাঁধের সংস্কার শুরু হবে। তবে জোয়ারের প্রভাব ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে ৮২টি পয়েন্টে বিধবস্ত বেড়িবাঁধের পুনঃসংস্কার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এসব কাজের বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
পাঠকের মতামত: