নিজস্ব প্রতিনিধি, কক্সবাজার ::
ক্ষষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় নির্বাচনের অংশ হিসেবে দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৌকা প্রতীকে ভোট চাইছেন। গত কয়েক সপ্তাহ আগে কক্সবাজার সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষে কক্সবাজারে নতুন করে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। এর মধ্যে কক্সবাজারের ৪টি আসনে মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের ২০ জন প্রার্থী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক জেলার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বিশেষ বর্ধিত সভা করেছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় প্রার্থীকে জয় করতে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এ বিশেষ বর্ধিত সভায়। কক্সবাজার থেকে ১১জন নেতা অংশগ্রহণ করেছিলেন এ বিশেষ বর্ধিত সভায়।
সূত্রমতে, অতীতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ একসঙ্গে কক্সবাজারের চারটি আসনে বিজয়ী হতে পারেনি। এমনকি গত নির্বাচনেও চারটির মধ্যে একটি আসন হাতছাড়া করতে হয়। কিন্তু আগামী নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনই পেতে চায় আওয়ামী লীগ।
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া)
এ আসন থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী আলোচনায় রয়েছেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় আহ্বায়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক ড. আশরাফুল ইসলাম সজিব, বর্তমান চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমদ সিআইপি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রেজাউল করিম।
এদের মধ্যে সালাউদ্দিন আহমদ সিআইপি অতীতে একাধিকবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েও নির্বাচিত হতে পারেননি। দলীয় নেতা হিসেবে গুরুত্ব থাকলেও তার জনসম্পৃক্ততা তেমন নেই। জাফর আলম অতীতে একাধিকার দলীয় টিকেট দাবি করলেও মনোনয়ন বঞ্চিত হন। তাই কোনোবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে গত চকরিয়া উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জাফর আলম। তবে বিভিন্ন সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরাদের সাথে বিতর্কে জড়ান তিনি। কয়েকবার চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য তাকে বহিষ্কারও করে। আবার গত জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেও কাউন্সিলরদের সমর্থনে এগিয়ে থাকলেও কাউন্সিল ছাড়াই কমিটি ঘোষণা হওয়ার কারণে ছিটকে পড়েন জাফর আলম।
তাছাড়া রেজাউল করিম বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তাই প্রত্যেক ইউনিয়নে গণসংযোগ করছেন। পাশাপাশি ইউনিয়ন- ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সাথে নিজের লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে জন সমর্থন বাড়াতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তবে ড. আশরাফুল ইসলাম সজিব তরুণ নেতা হিসেবে দ্রুত নিজেকে জনগণের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে তরুণ এই নেতা অনেক এগিয়ে রয়েছেন বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া)
এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন বর্তমান সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. সিরাজুল মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ড. আনছারুল করিম ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ওসমান গণি। এর মধ্যে অ্যাড. সিরাজুল মোস্তফা ও ড. আনছারুল করিম অতীতে দলীয় টিকেট পেয়েও সংসদে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর ওসমান গণি নিজেকে জনগণের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর ভোটবিহীন নির্বাচিত হলেও তরুণ সাংসদ হিসেবে ইতোমধ্যে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার মানুষের অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছেন আশেক উল্লাহ রফিক। কক্সবাজারের ৪টি আসনের মধ্যে জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মহেশখালী-কুতুবদিয়ার এ আসনটি। বিগত নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের র্শীষ নেতা হামিদুর রহমান আজাদ দাঁড়ি-পাল্লা প্রতীক নিয়ে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। তাই এ আসনে প্রার্থীকে বিজয় করতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কারণ কক্সবাজার জেলায় মহেশখালীতে সব চেয়ে বেশি উন্নয়ন করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার।
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু)
এ আসন থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছে বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কানিজ ফাতেমা আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাশেদুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনিন সরওয়ার কাবেরী, রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল ও কক্সবাজার উন্নয়ন কতৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব.) ফোরকান আহমদ। এর মধ্যে বর্তমান সাংসদ কমলের পরিবারে তিন জন মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাই ঘরোয়া বিরোধের জেরে রাজনীতিতে সম্পূর্ণ দুইভাবে বিভক্ত রামুতে বর্তমান সাংসদ কমল নিজেকে তুলে ধরতে এবার সফল নাও হতে পারেন।
কারণ ঘরের মধ্যেই ঘোর বিরোধী রয়েছে সাংসদ কমলের বড় ভাই উপজেলা সভাপতি কাজল। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করবেন না সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা। তাছাড়া ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় টিকেট পেয়েও সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল বিএনপির প্রার্থীর কাছে চরম পরাজিত হওয়ার বিষয়টিও আগামী নির্বাচনের মনোনয়নে বিবেচ্য হতে পারে।
এছাড়া সফল নারী নেত্রী হিসেবে কানিজ ফাতেমা আহমেদের দিকে সবুজ সংকেত রয়েছে। তবে মুজিবুর রহমানের জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনপ্রিয়তা কিছুটা বেড়েছে। বিগত পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে হেরেছেন জামায়াত প্রার্থীর কাছে। মুজিবুর রহমানের পক্ষে একাদিক কেন্দ্রীয় নেতার সমর্থন রয়েছে। একইভাবে দলীয় মনোনয়ন আশাবাদী বর্তমান সাংসদের বোন নাজনিন সরওয়ার কাবেরিও। এছাড়াও আগামী নির্বাচনে কক্সবাজার নিয়ে দলীয় প্রধানের দূরদর্শী চিন্তাধারাও রয়েছে বলে ধারণা করছেন শীর্ষ নেতারা। দক্ষ সংগঠক ও ক্লিন ইমেজের জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাশেদুল ইসলাম। দুঃসময়ে দলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তার। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাকে একবার মহাজোট থেকে মনোনয়নও দেন। অতীতে বিএনপি পারলেও আওয়ামী লীগ এখনো কক্সবাজার থেকে একজনও মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী করতে পারেন নি। আর তাই আগামী নির্বাচনে বর্তমান কউক চেয়ারম্যান ও সাবেক দক্ষ সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদকে দিয়ে আওয়ামী লীগ সেই অভাবটি পূরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ফোরকান আহমদের সম্পর্কে দলীয় প্রধানের বাস্তব ধারণা রয়েছেন। তাই আগামী নির্বাচনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ফোরকান আহমদকেও দলীয় টিকেট দিতে পারেন বলে ধারণা করছেন অনেকে। এরই মধ্যে সাংসদ কমলের বড় ভাই রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজলও মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে লবিং শুরু করে দিয়েছে। রামু উপজেলায় দুই ভাইয়ের দ্বন্দের কারণে দলীয় কর্মকান্ড ঝিমিয়ে পড়েছে বলে দাবি করছেন আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা তাদেরকে দায়ী করছেন।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ)
এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান সাংসদ আব্দুর রহমান বদি, সাবেক সাংসদ ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, জেলা পরিষদ সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিক মিয়া, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ্ আলম ওরফে রাজা শাহ আলম ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী।
এর মধ্যে শাহ আলম ওরফে রাজা শাহ আলম ও হামিদুল হক চৌধুরীর জনসম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মোহাম্মদ আলী ও শফিক মিয়ার জনপ্রিয়তা ও জনসম্পৃক্ততা থাকলেও বর্তমান সাংসদ আব্দুর রহমান বদির জনপ্রিয়তার কাছে ধরাশয়ী তারা। যদিও ইয়াবা চোরাচালান বিষয়ে সারাদেশে আলোচিত-সমালোচিত বদি। অনেকেই তাকে বর্তমান সরকারের ভাবমুর্তি নষ্টের জন্য দায়ী করেন। কিন্তু এই আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর সাথে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনা একমাত্র বদির পক্ষেই সম্ভব।
কারণ ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জন্য বিতর্ক থাকলেও উখিয়া-টেকনাফের প্রতিটি মানুষের অন্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন আব্দুর রহমান বদি। একারণে অনেকেই দাবী তুলছেন পূণরায় ওই আসনে দলকে বিজয়ী করতে আ.লীগ থেকে আব্দুর রহমান বদিকে মনোয়ন দিতে।
অনেকেই তাকে বর্তমান সরকারের ভাবমুর্তি নষ্টের জন্য দায়ী করেন। আওয়ামী লীগ সরকার দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ইয়াবা, মানবপাচার ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত উখিয়া-টেকনাফেন এ আসনটি। ইয়াবা ও মানব পাচারের স্বর্গরাজ্য হিসেবে সারাদেশে আলোচিত এই অঞ্চলটি। সেই বদনাম ঘুচাতে আওয়ামী দলীয় সভানেত্রী সম্প্রতি কক্সবাজারে একটি জনসভায় ইয়াবার বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সভানেত্রীর এই হুঁশিয়ারি থেকেই অনেকে ধারণা করছেন উখিয়া-টেকনাফ আসনে আওয়ামী লীগে পরিবর্তন আসতে পারে। সেই হিসাবে দলীয় মনোনয়ন পেতে অনেক প্রার্থী নতুন করে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন।
দেশের শেষ সীমান্তের উখিয়া-টেকনাফ আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই অঞ্চলের ইয়াবা ও মানবপাচারের বদনাম মুছতে আওয়ামী লীগ নতুন প্রার্থী দিতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিশ্বাস সবদিক বিবেচনা করে এই আসনে প্রার্থী দিতে ভুল করবেন না দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
পাঠকের মতামত: