ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজারে ৭ শতাধিক ইয়াবা বিক্রেতা: অধিকাংশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি জড়িত

yabaনিউজ ডেস্ক::

সরকারের বহুমুখী তৎপরতায় সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধে ভাটা পড়েছে। অর্থাৎ সফলতা এসেছে। স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাওয়ার পথে গভীর সমুদ্রে ইঞ্জিনচালিত বোট বা ট্রলার ডুবে প্রাণ হারিয়েছে অগণিত আদম সন্তান। এছাড়া যাওয়ার পথে থাইল্যান্ডের বন্দীশিবিরে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্মম নির্যাতনের ফলে প্রাণ হারিয়ে গণকবরের বাসিন্দা হওয়ার মর্মস্পর্শী ঘটনাবলী উদ্ঘাটিত হওয়ার পর মানুষের সচেতনতা বহুলাংশে বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কঠোর পদক্ষেপ। ফলে দুর্গম ও অবৈধ এ ভয়ঙ্কর যাত্রার মিছিল ব্যাপকভাবে রোধ হয়েছে। এ তথ্য কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রসমূহের।

অপরদিকে মরণনেশা মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট সীমান্ত গলে আসার পথ কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। যে কারণে দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর ইয়াবার ছোবলে আসক্ত হওয়ার সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত এ ইয়াবা ট্যাবলেট প্রকারভেদে বিভিন্ন মূল্যের।

সব ধরনের ইয়াবার চালান আসছে স্থল ও সমুদ্র পথে। সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারে চল্লিশটির মতো কারখানা গড়ে উঠার পরও সে দেশের সরকার এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কূটনৈতিক পর্যায়ে এসব অবৈধ কারখানা গড়ে উঠার বিষয়টি জানানো হলেও সে দেশের সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েও এগিয়ে আসেনি। ফলে প্রতিনিয়ত ওই সব কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা সীমান্ত গলে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে চলে আসছে।

সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, জেলা শহর কক্সবাজারের বিপুলসংখ্যক মানুষ ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এবং প্রতিদিন তা বাড়ছে। সমাজের প্রভাবশালীরা এ ব্যবসার নেপথ্যে থেকে কাড়ি কাড়ি অর্থ মুনাফা হিসেবে হাতিয়ে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে, ইয়াবার নীল দংশনে দেশের উঠতি বয়সের যুবক-যুবতী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিদিনই ইয়াবার চালান কোন না কোনভাবে আসছে। কিন্তু সে অনুপাতে ধরা পড়ছে না। কখনও হাজার, কখনও লাখ পিসের চালান ধরা পড়ছে র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে। কিন্তু থামানো যাচ্ছে না।

পাশাপাশি গডফাদাররাও ধরা পড়ছে না। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আঁতাত করে গডফাদার ও এর সহযোগীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সরকারী নির্দেশে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত গডফাদার ও সহযোগীদের নাম উল্লেখ করে রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে বহু আগে। কিন্তু এদের ধরা যাচ্ছে না। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা সরকারদলীয় তাদের গ্রেফতার করা আরও কঠিন। আবার পয়েন্টে পয়েন্টে সবকিছু ঠিক রেখে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত দু’বছরে ২ কোটি পিসেরও বেশি ইয়াবা আটক হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পৃথক পৃথক অভিযানে এসব ইয়াবার চালান ধরা পড়েছে। সূত্র জানায়, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষে কক্সবাজারের সাত প্রভাবশালীসহ ৭৬৪ ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এরপরও এসব প্রভাবশালী ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

সাধারণত, যারা ধরা পড়ে তারা বাহক। এরা জানে না চালানের মূল গডফাদার কে বা কারা। সম্প্রতি কক্সবাজার জেলার ইউপি নির্বাচনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৩০ জনেরও বেশি ইয়াবা ব্যবসায়ী নির্বাচিত হয়েছে। এ ব্যাপারে বেসরকারী সংস্থা নোঙ্গরের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ জানান, ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের একটি অংশ কক্সবাজার জেলার আওতায় বিভিন্ন উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক।

কক্সবাজারে ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে শীর্ষ জনপ্রতিধিদের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে ইয়াবার চোরাচালান যেভাবে বেড়ে চলেছে, তা রীতিমতো সব ধরনের চোরাচালানকে হার মানাচ্ছে।

বিজিবি সূত্রে জানানো হয়, সীমান্ত এলাকাসহ কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা সাত শতাধিক। এদের আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব পুলিশের।

সূত্রে জানা গেছে, ’৯০ দশকের শুরুতে দুবাই, পাকিস্তান থেকে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এসব ইয়াবা এদেশে প্রবেশ করলেও তা ছিল ব্যয়বহুল ও সীমিত আকারে। ওই সময় এক একটি ইয়াবা ট্যাবলেট তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হওয়ার সুবাদে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা ছিল নগণ্য। ২০০৫ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে এসব ইয়াবা তৈরি শুরু হয়। মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন নেশাজাতীয় উপকরণ ও কাঁচামাল দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে ইয়াবা তৈরি করে চোরাপথে এদেশে পাচার শুরু করে।

মিয়ানমারের তৈরি একেকটি ইয়াবা ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হলেও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফে আসার পর ঘুষ লেনদেনসহ প্রতিটির মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় ১৫০ টাকা পর্যন্ত। এরপর চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছার পর এসব ট্যাবলেটের মূল্য তিনশ’ থেকে ৫শ’ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।

পাঠকের মতামত: