নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: এক কেজি লবণের উৎপাদন খরচ ৮ দশমিক ৭৫ টাকা। চাষি বেচছেন ৬ টাকায়। মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে মিলার কিনছেন ৮ দশমিক ৫০ টাকায়। প্রক্রিয়ার পর উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ২৪-২৫ টাকা। বাজারে খুচরা বেচা হয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। অথচ গত বছর চাষি লবণ বেচেছেন ১০ টাকা কেজিতে। এ বছর দাম কমার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
উৎপাদন বেশি, তবু আমদানি
প্রতিবছর ডিসেম্বরে শুরু হয় লবণ আহরণ। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে তা চলে এপ্রিল পর্যন্ত। এবার মৌসুমের শুরু থেকে দাম কমে যাওয়ায় লোকসানে পড়েছেন চাষিরা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের পরিদর্শক ইদ্রিস আলী জানান, দেশে পরিশোধিত লবণের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৫ লাখ টন। এ বছর অপরিশোধিত লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৬ লাখ ১০ হাজার টন।
এদিকে চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হলেও মাঝেমধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় লবণ। গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৬৪টি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমোদন দেয়। অথচ গত বছর উৎপাদিত চার লাখ টন লবণ গুদামজাত করে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে চাহিদার অর্ধেক লবণ গৃহস্থালি ও খাবার তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। অবশিষ্ট লবণ চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, টেক্সটাইল, কাগজ, সাবান, ডিটারজেন্ট ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির কাজে লাগে।
দেশে লবণ উৎপাদন হয় দুই জেলায়। কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, সদর, ঈদগাঁও ও টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। এ দুই জেলায় অন্তত ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রায় ৬৫ হাজার চাষি এর সঙ্গে জড়িত।
চাষি, ব্যবসায়ী ও বিসিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে মাঠ পর্যায়ে লবণ সংগ্রহ করে বিভিন্ন মিলকারখানা মালিকের কাছে বেচে মধ্যস্বত্বভোগীরা। মিল মালিকদের প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন এলাকা থেকে লবণ সংগ্রহ করে। মূলত এই মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম বাড়ায়-কমায়। আবার তাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে লবণ বাজারজাতকারী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বড় মাপের মিল মালিকরা। দুই পক্ষের মর্জির ওপর নির্ভর করে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কত পড়বে। তাদের কবলে পড়ে ক্ষতির শিকার হন চাষিরা।
চকরিয়ার রামপুরের চাষি মৌলভি মো. সেলিম জানান, আগে ভালো দাম পাওয়ায় তিনি এবার গত বছরের চেয়ে বড় পরিসরে লবণ চাষ করেন। কিন্তু বেচতে গিয়ে রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মৌলভি বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগী ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে এবার লবণের দরপতন ঘটিয়েছেন। তারা আমাদের পেটে লাথি দিয়ে পকেট ভারি করছেন। তাই কিছু লবণ আহরণের পর বন্ধ করে দিয়েছি। লাভ না হোক, এত লোকসান দিলে কীভাবে চলবে? আমার মতো অন্য চাষিরা লবণ আহরণ কমিয়ে দিয়েছেন। ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ আহরণ করছেন।’
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ঈদমনি গ্রামে লবণ চাষি মো. আলমগীর হোসেন, আবদুল কাদের, হেফাজ উদ্দিন ও আবদুর রহিম জানান, তারা গরু বেচে সাড়ে পাঁচ একর জমি বর্গা নিয়ে লবণ চাষ করেন। গত শুক্রবার তারা প্রায় ১৭৪ মণ লবণ বেচেন। চুক্তি অনুযায়ী, এর অর্ধেক পাবেন জমি মালিক। বাকি অর্ধেক পাবেন চার চাষি। এবার তারা প্রতি মণ লবণ বেচেন ২৪০ টাকা। অথচ প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে তাদের খরচ হয়েছে কমবেশি ৩০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি মণ লবণে চাষিদের গচ্চা দিতে হচ্ছে গড়ে ৫০ টাকা।
এ প্রতিবেদকের কাছে লবণ চাষে লাভ-লোকসানের চিত্র তুলে ধরেন চকরিয়ার লবণ চাষি মো. আলমগীর হোসেন। তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর চোখ টলমল করছিল। তিনি বলেন, জমি বর্গা, পানির স্কিম, পলিথিন, শ্রমিক, আনুষঙ্গিকসহ চাষিদের প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে গড়ে খরচ হয় ৩০০ টাকার ওপরে। যখন বেচতে যাই, তখন কোনোভাবে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকার বেশি পাই না। প্রতি মণে লোকসান গুনতে হচ্ছে কমপক্ষে ৫০ টাকা।
বাঁশখালীর গণ্ডামারার চাষি জামাল উদ্দিন বলেন, ‘গত বছর প্রতি মণ লবণ ৪০০ টাকার বেশি বেচেছি।’
চকরিয়া উপজেলার ইলিশিয়া দক্ষিণপাড়ার লবণ চাষি মো. জমির উদ্দিন বলেন, ‘এবার আমি ধারদেনা করে প্রায় দুই একর জমিতে লবণ চাষ করেছি। উৎপাদিত লবণ বেচে যা পেয়েছি, তা দিয়ে শ্রমিকের মজুরিও পরিশোধ করা যাচ্ছে না।’
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
কক্সবাজারের ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আজাদ বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি এবার অন্যান্য পণ্যের মতো লবণের দামেও প্রভাব ফেলেছে। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার দাম কিছুটা কম। তা ছাড়া মিডলম্যান ছাড়া লবণ সংগ্রহ করা যায় না। মিডলম্যানদের কাছ থেকে আমরা এবার প্রতি বস্তা (৮০ কেজি) ৬৮০ টাকা দরে সংগ্রহ করছি। এ হিসাবে প্রতি মণ লবণের দাম পড়ছে ৩৪০ টাকা।’ এ বছর ১০ হাজার টন লবণ সংগ্রহ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রহ পরিষদের সদস্য সচিব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কিছু মিল মালিক সিন্ডিকেট করে চলতি মৌসুমের শুরুতে উৎপাদিত লবণের মূল্য কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে লবণ চাষের সঙ্গে জড়িত চাষিরা পুঁজি হারানোর ভয়ে আছেন।’ তিনি জানান, ওজনেও কারচুপি করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। ৪০ কেজিতে এক মণ হলেও তারা মণ হিসাব করেন ৪৫ কেজিতে।
প্যাকেটজাত লবণ বিক্রয়কারী কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, দেশে তিন পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধিত হয়। ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন, মেকানিক্যাল ও সনাতনী। এক কেজি পরিশোধিত লবণ উৎপাদনে প্রক্রিয়াকরণ ক্ষতি ১২ টাকা। অন্যান্য উপকরণ, পরিচালন ও আর্থিক ব্যয় মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ২৪-২৫ টাকা। কোম্পানিগুলো লবণ বেশি বেচার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভের হার বেশি দিয়ে থাকে, ৯ থেকে ১২ টাকা। এ কারণে খুচরায় দাম কমে না।
পাঠকের মতামত: