ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজারে উপর্যুপরি ভূমিকম্প ভাঙনের মুখে কয়েক হাজার পাহাড়

আহমদ গিয়াস :
গত বছর দেশে ত্রিশ বারের বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। নতুন বছরের ৩ জানুয়ারি অনুভূত হয়েছে শক্তিশালী মাত্রার একটি ভূমিকম্প। দিন দিন ভূমিকম্পের প্রবণতা বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে পাহাড় ধসের আশংকাও। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের কয়েক হাজার পাহাড়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে, নতুন কোন ভূমিকম্প অথবা তীব্র বর্ষণের ফলে এসব পাহাড় ভেঙে পড়ে ভয়াবহ কোন বিপত্তি তৈরী করতে পারে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপর্যপুরি ভূমিকম্পের প্রভাবে কক্সবাজারের পাহাড়গুলোর মৃত্তিকাবন্ধন দূর্বল হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার পাহাড়ে দেখা দিয়েছে ফাটল। এই পাহাড়গুলো টুকরো টুকরো এখন ভেঙে পড়ছে। সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে শহরতলীর দরিয়ানগর বড়ছড়াস্থ বানরের পাহাড়ে বিকট শব্দে ধসের ঘটনা ঘটে। এসময় দরিয়ানগর এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে আতংকের সৃষ্টি হয়। রামুর মেরিন ড্রাইভ এলাকাতেও প্রায় সময় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে বলে জানান স্থায়ী বাসিন্দারা।
দরিয়ানগর এলাকার বাসিন্দা আয়েশা বেগম জানান, প্রতিদিন রাতে বানরের পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটে। এসময় স্থানীয় অধিবাসী ও প্রাণিকূলে আতংকের সৃষ্টি হয়। গত বর্ষা মৌসুমের একেবারে শেষদিকে এই পাহাড়ে স্মরণকালে সবচেয়ে বড় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি।
টেকনাফের সদর ও বাহারছড়াতেও উঁচু পাহাড়গুলো টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে পড়ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা আরো জানান- উক্ত এলাকার শত শত পাহাড়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। একই ঘটনা রামুর সমুদ্র তীরবর্তী উঁচু পাহাড়গুলোতে ঘটেছে বলে জানান স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ।
জানা গেছে, ভূমিকম্পের তীব্রতার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে তীব্র ঝুঁকির মুখে রয়েছে কক্সবাজারের একাংশও। বুয়েটের গবেষকদের সাম্প্রতিক প্রস্তুতকৃত ভূ-কম্পন-এলাকাভিত্তিক মানচিত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে (জোন-১), ৪১% এলাকা মধ্যম ঝুঁকিতে (জোন-২) এবং ১৬% এলাকা রয়েছে নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩)। যদিও ১৯৯৩ সালের ভূ-কম্পন মানচিত্রে ২৬% উচ্চ, ৩৮% মধ্যম এবং ৩৬% নিম্ন ঝুঁকিতে ছিলো। নতুন মানচিত্র অনুযায়ী, তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুঁড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পূর্ণ অংশ, এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ (জোন-১), মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী এবং ঢাকা (জোন-২), বরিশাল, পটুয়াখালী, এবং সব দ্বীপ ও চর (জোন-৩)। ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারিত হয় কেন্দ্রে উৎপন্ন শক্তির পরিমাপ করে। রিখটার  স্কেলের চেয়ে নিখুঁত কম্পন মাপা হয় ‘মোমেন্ট ম্যাগনিচিউড’ পদ্ধতিতে। এর মাধ্যমে বড় আকারের ভূকম্পন পরিমাপ সম্ভব হয়।
ভূকম্পনের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ভূমিকম্পকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে রিখটার স্কেলে ৮.০ মাত্রার ওপরে ভূ-কম্পন অনুভূত হলে ‘গ্রেট আর্থকোয়াক’ তীব্র ভূমিকম্প বলা হয়; যার আঘাতে কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হতে পারে তা বলা দুষ্কর। আর ৭.০-৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে বলা হয় ‘মেজর আর্থকোয়াক’ বা মাঝারী আকারের ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে। ‘স্ট্র’ ভূমিকম্প বলা হয় ৬.০-৬.৯ মাত্রার ভূকম্পনকে। এ ভূকম্পনকেও শক্তিশালী বলে বিবেচনা করা হয়। ৫.০-৫.৯ মাত্রার ভূ-কম্পনকে ‘মডারেট’ ভূমিকম্প হিসাবে বিবেচিত হয়। এর বাইরে রয়েছে মাইনর আর্থকোয়াক যার মাত্রা ৩.০-৩.৯ পর্যন্ত। আর ৩.৩ ম্যাগনিচিউডের কম মাত্রার ভূমিকম্পকে ‘মাইক্রো’ ভূমিকম্প বলে ধরে নেওয়া হয়। এই দুই মাত্রার ভূমিকম্পে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতি সাধিত হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইটঊঞ) মানমন্দিরে জানুয়ারি ২০০৬ থেকে মে ২০০৯ পর্যন্ত ৪ বছরে রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার ৮৬টি ভূ-কম্পন নথিভুক্ত করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ৫ মাত্রার চারটি ভূ-কম্পনও ধরা পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানমন্দিরে মে ২০০৭ থেকে জুলাই ২০০৮ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভূ-কম্পন নথিভুক্ত করা হয়, যারমধ্যে ৯টির মাত্রাই ছিলে রিখটার স্কেলে ৫-এর ওপরে এবং সেগুলোর ৯৫%-এরই উৎপত্তিস্থল ছিলো ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ২০টি ভূমিকম্প নথিভূক্ত হয়। জাপানে একবছরে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ভূমিকম্প হয়। তবে বাংলাদেশে দিনদিন ভূমিকম্প বাড়ছে। এসব ছোট ছোট ভূমিকম্প ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। অতীতের রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষকরা যে কোনও সময় বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন। আর সে মাত্রার ভূমিকম্প হলে কক্সবাজারে ফাটল ধরা উঁচু ও খাড়া পর্বতগুলো কী ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা বলা দুষ্কর বলে মনে করছেন গবেষকরা।

পাঠকের মতামত: