ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

এলএ শাখার ‘দুর্নীতিবাজ’ ৩০ কর্মকর্তার একযোগে বদলী

নিজস্ব প্রতিবেদক ::  অবশেষে টাকার খনি কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখা থেকে ‘ঘুষ লেনদেনে’ জড়িত সন্দেহে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৩০ জন কর্মকর্তাকে। আগামী ৫ মার্চের মধ্যে কর্মস্থল ত্যাগ করতে নির্দেশনা দিয়ে বৃহস্পতিবার বদলীর আদেশ দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এতে কিছুটা সন্তুষ্টি বিরাজ করলেও, ভুক্তভোগী অনেকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দায় মুক্তি হিসেবে দেখছেন গণ বদলীর আদেশকে।
তবে এত সহজেই দায়মুক্তি পাচ্ছেন না বদলীর আদেশ পাওয়া ৩০ জন কর্মকর্তা। এলএ শাখায় ঘুষ লেনদেনের সিন্ডিকেটে তারা জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখতে পৃথক আদেশে তদন্ত করতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে। ২৭ ফেব্রæয়ারীর পর থেকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে সার্বিক দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তদন্তকে যাতে প্রভাবিত করতে না পারে সেজন্য এলএ শাখার এসব কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দৈনিক কক্সবাজারকে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান। তদন্ত প্রতিবেদনে ঘুষ লেনদেনে সম্পৃক্ততা পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রæয়ারী) ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব মোছাম্মৎ মমতাজ বেগম এই আদেশ দেন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার ওয়াসিম খান নামে একজন সার্ভেয়ারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে। এ ঘটনায় আরও দুই সার্ভেয়ার এখনও পলাতক রয়েছে, যাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া র‌্যাব-১৫ জানিয়েছিল তারা ঘুষ লেনদেনের জন্য একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সব কর্মচারিকে তাৎক্ষনিক বদলি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ প্রদান করেন।
মন্ত্রীর নির্দেশনায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের তিনটি পৃথক প্রজ্ঞাপন দ্বারা আদেশ জারি করার মাধ্যমে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কর্মরত ৩০ জন কর্মকর্তাকে বদলী করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, ৭ জন কানুনগো ও ১৯ জন সার্ভেয়ার।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে ‘বর্ণিত কর্মকর্তাগণ আগামী ৫ মার্চের মধ্যে বর্তমান কর্মস্থল হতে অবমুক্ত হবেন। অন্যথায় আগামী ৫ মার্চের অপরাহ্নে বর্তমান কর্মস্থল হতে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত (স্যান্ড রিলিজ) বলে গণ্য হবেন।’ তিন সার্ভেয়ারের বাসা থেকে ‘ঘুষের’ বিপুল টাকা উদ্ধার ও সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খানকে আটকের আট দিনের মাথায় এ আদেশ জারি করা হলো।
সূত্রমতে, গত ১৯ ফেব্রæয়ারী জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কর্মরত তিন সার্ভেয়ারের বাসা থেকে ‘ঘুষের’ বিপুল টাকা উদ্ধার ও সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খানকে আটক করে র‌্যাব। এসময় সার্ভেয়ারদের বাসা থেকে বিপুল সরকারি নথি, হাতে লেখা হিসাব বিবরণীর নোটবুক ও ডায়েরী, মাসোহারা গ্রহণকারীদের তালিকা উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনার পর গত রোববার কক্সবাজার সফরে আসেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। ওইসময় জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তিনি ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের ঈঙ্গিত দিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে এই গণবদলীর আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
এদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বদলীর আদেশের পূর্ণাঙ্গ কপি এসেছে দৈনিক কক্সবাজারের কাছে। আদেশে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কর্মরত ১৯ জন সার্ভেয়ার, ৭ জন কানুনগো এবং ৪ জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে বদলী করা হয়েছে। বিপরীতে বিভিন্ন জেলায় কর্মরত ১৫ জন সার্ভেয়ার, ৩ জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা এবং ২ কানুনগো’কে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় সংযুক্ত করা হয়েছে। পদ কম থাকলেও চাহিদা বেশি থাকায় অন্য জেলায় পদায়ন করে কক্সবাজার এলএ শাখায় সংযুক্ত করা হয়েছে এসব কর্মকর্তাদের। তাদেরকেও আগামী ৫ মার্চের মধ্যে এলএ শাখায় যোগদান করে যোগদানপত্র ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওই আদেশের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে বদলীর আদেশ হওয়া ১৯ জন সার্ভেয়ার হলেন- মো. আব্দুল বারিক, মো. সাইফুল আলম, মো. কামরুল হাসান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. ফেরদৌস খান, রাসেল মাহমুদ মজুমদার, কবির আহমেদ, পিকলু চৌধুরী, মো. আবুল কাশেম, মিশুক চাকমা, পরিমল চন্দ্র দাশ, মো. কামরুল আলম, মো. আবুল খায়ের, মো. ফরিদ উদ্দিন, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আনোয়ার কবির আনন্দ, মো. ওয়াসিম খান, রিপন চাকমা, আব্দুল কুদ্দুস। এরমধ্যে ওয়াসিম খান বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির টাকাসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরীন। ফেরদৌস খান এবং ফরিদ উদ্দিন বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
এলএ শাখায় কর্মরত সার্ভেয়াররা একেকজন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। নানা অজুহাত এবং ফন্দি এটে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অধিগ্রহণ হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তদন্তে তারা ঠিকই ‘দুর্বল তদন্ত ব্যবস্থার’ ভাঙা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা ভুক্তভোগীদের।
এদিকে ১৯ জন সার্ভেয়ারের একযোগে বদলীর পর সার্ভেয়ার শূন্য হয়ে যাবে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা। সেখানে দায়িত্বপালন করার জন্য নতুন ১৫ জন সার্ভেয়ারকে বিভিন্ন জেলা থেকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকজনকে সরাসরি এলএ শাখায় বদলী করা হয়েছে। তাদেরকে আগামী ৫ মার্চের মধ্যে দায়িত্বে যোগদান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নতুন যে ১৫ জন সার্ভেয়ারকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় সংযুক্তির আদেশ দেওয়া হয়েছে তারা হলেন- মো. দুলাল খান, সুব্রত হালদার, মো. ইব্রাহিম ফয়সাল, মো. আবুল কালাম, আইএম আশরাফুজ্জামান, মো. ফিরোজ আহমেদ, মো. আলতাফ হোসেন, মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, উজ্জ্বল কুমার, হযরত আলী, মো. আব্দুল কাইয়ুম, মো. আতিকুর রহমান মীর্জা মো. নুরে আলম, মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. জিয়াউর রহমান।
বদলীর প্রজ্ঞাপন থেকে আরও জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা থেকে যে ৭ জন কানুনগোকে বদলী করা হয়েছেন তারা হলেন- মো. আব্দুল বাতেন, মো. মোখলেসুর রহমান, মো. আব্দুর রহমান, মো. আবুল কালাম, মিলন কান্তি চাকমা, ¤্রাগ্র মারমা ও আব্দুল খালেক।
পৃথক আদেশে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় দায়িত্বপালন করার জন্য ২ জন কানুনগোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- মো. নুরুল ইসলাম ও মো. কামরুল হাসান। তারাও আগামী ৫ মার্চের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন।
বদলীর আদেশে সার্ভেয়ার ও কানুনগো ছাড়াও ৪ জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে কক্সবাজার এলএ শাখা থেকে বদলী করা হয়েছে। তারা হলেন- মো. মোশারফ হোসেন, মো. নজরুল ইসলাম, বিজয় কুমার সিংহ ও বেদতোষ চক্রবর্তী।
নতুন করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ৩ জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার (অতিরিক্ত এলও) সংযুক্তির আদেশ দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন- মো. আতাউর রহমান, আ.ন.ম জাহেদুল ইসলাম ও মো. সাইফুল ইসলাম।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন জেলায় কর্মরত অপেক্ষাকৃত সততার গুডবুকে থাকা সার্ভেয়ার, কানুনগো ও অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাদেরকে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় নতুন করে দায়িত্বপালন করার জন্য সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে তাদেরকেও বিশেষ নজরদারিতে রাখা হবে বলে জানা গেছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের বদলীর আদেশের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। কক্সবাজারের অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার বলেন, ভূমি ব্যবস্থা ও রাজস্ব প্রশাসন ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া এটি। ভূমি প্রশাসনে চলমান জনদুর্ভোগ এবং অনিয়ম কমানোর জন্য এই উদ্যোগটি মাইল ফলক হবে।

পাঠকের মতামত: