ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার :
‘প্রতি বছর সরকারকে কোটি টাকা রাজস্ব দিই। আমাদের টাকায় আপনাদের বেতন। আপনারা যে দুর্নীতি করেন না,তা নয়। সামান্য টাকায় চাকরি করে আপনারাও তো অনেকে অঢেল সম্পদের মালিক। আপনাদের সম্পদের হিসাব আগে দিন। সম্পদের হিসাব দেয়ার জন্য যারা আমাকে নোটিশ দিয়েছেন, তাদের সম্পদের হিসাব আগে নিন। আমাকে কারাগারে ঢুকিয়েছেনÑ ভালো কথা। দুর্নীতি কি বন্ধ হয়েছে? আল্লাহর হুকুমে আমাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। দুর্নীতি করলে মানুষের এত ভালোবাসা পেতাম না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলেই আমি আদালতে গিয়েছি। আদালতে আমি নির্দোষ হয়েছি। অল্প সময় কারাগারে থাকতে হলেও আমি আবারো জনগণের কাতারে চলে এসেছি। জনগণই আমার সম্বল, শেষ ভরসা।’
জ্ঞাতআয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপনের দায়ে ২ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালত এমপি বদিকে তিন বছরের সাজা দেন। একই সাথে তাকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায় ঘোষণার পর সে দিনই তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। ২০ নভেম্বর রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।
গত বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে গণসংবর্ধনা সভায় কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্দেশে এসব কথা বলেছেন। এর আগে বেলা ১টার দিকে কারামুক্ত এমপি বদি কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখান থেকে শতাধিক গাড়ির বহরে তাকে নিয়ে সমর্থকরা উখিয়া-টেকনাফের পথে রওনা হন। উখিয়া-টেকনাফের ডজনখানেক পথসভায় বক্তব্য রাখেন এমপি বদি। দুদকের উদ্দেশে বদি বলেন, আমার হাত ধরে অন্তত ১৫০০ লোকের চাকরি হয়েছে। তাদের কারোর কাছ থেকে ১ পয়সা নিয়েছি প্রমাণ নেই।
দায়িত্ব পালনে বিগত আট বছরে কোনো উন্নয়ন কাজ থেকেই একটি টাকাও নিয়েছি, এমন নজিরও কেউ দিতে পারবে না। দুর্নীতির প্রমাণ দিন, সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবো।
তিনি বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকাকে নিজের মতো করে সাজিয়েছি। গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষকে আপন করে নিয়েছি। তারা আমাকে বিশ্বাস করে। খেটে খাওয়া মানুষই আমার সম্মানের পাত্র। তাদের ভালোবাসা-ঋণ গায়ের চামড়া, এমনকি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও শোধ করতে পারব না।
উখিয়া-টেকনাফের গণমানুষের ভোটে আমি এমপি নির্বাচিত হয়েছি। তাদের কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।
বদি দুঃখ করে বলেন, কিছু মিডিয়া আমাকে ‘দুর্নীতিবাজ’ বানিয়েছে। ইয়াবা ও মানবপাচারকারী হিসেবে লিখেছে। আদালতে তা প্রমাণ হয়নি। আমি এসব অপকর্ম করে থাকলে মানুষ এভাবে আমাকে ভালোবাসত না। আমাকে বরণ করতে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকত না। বক্তব্য শুনতে পথে পথে মানুষ জমায়েত হতো না। এটিই প্রকৃত জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসার প্রমাণ।
আল্লাহকে ‘হাজির নাজির’ জেনে আবদুর রহমান বদি বলেন, ‘আমি জীবনেও টেন্ডারবাজি করিনি। ভূমিদস্যুতা করিনি। চাঁদাবাজি করিনি। দুর্নীতি-অনিয়ম করিনি। আমি জমিদার পরিবারের সন্তান। পিতার অঢেল সম্পদে বড় হয়েছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে দেখে-শুনে মনোনয়ন দিয়েছেন। দুর্নীতি করার জন্য নয়।’
দুঃখভরে তিনি বলেন, আমি নিয়মিত সরকারি করদাতা। বৈধ বাণিজ্য করেই একাধিকবার সেরা করদাতার স্বীকৃতি পেয়েছি। এবারও সর্বোচ্চ কর দিয়েও মিথ্যা অভিযোগের মামলায় সাজার কারণে স্বীকৃতি হাতছাড়া হয়েছে।
আবদুর রহমান বদি আরো বলেন, গুটিকয়েক ব্যক্তির কারণে উখিয়া-টেকনাফের গায়ে ইয়াবা-মানবপাচারের কালিমা লেগেছে। এসব হারাম ব্যবসার একটি টাকাও এমপি বদি ও তার পরিবারের কারো রক্তে মিশেনি। অথচ বদনামটি বদির ওপরই বার বার পড়েছে। এটি আর চলতে দেয়া যায় না।
বদি বলেন, ইয়াবা ও মানবপাচারকারীদের তালিকা দিন। এরাই আমার জন্য অভিশাপ। সবার সহযোগিতায় তাদের ঘরছাড়া করা হবে। এখান থেকেই শেখ হাসিনার দিনবদলের ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরু হবে তিনি বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ সব দলের চেয়ারম্যানরা আমার মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন। সাধারণ মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। তাদের কাছে আমি চিরঋণী।
কোনো সরকারই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাড়াতে সাহস করেনি। শেখ হাসিনা সরকার সবার বেতন বাড়িয়ে নজির সৃষ্টি করেছে। ঘরে ঘরে চাকরি দিচ্ছে।
দুই উপজেলার সংবর্ধনা সভায় বদি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে। আপনাদের সমর্থন পেলে ২০১৯ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারি। ‘আপনারা কি আমাকে চান?’ প্রশ্ন করলে সভায় উপস্থিত সবাই হাত তুলে সম্মতি জানান।
সভায় তিনি রাস্তাঘাট, দরিদ্র পরিবারের বিবাহ, বেকারদের কর্মসংস্থান, পড়ালেখা সব বিষয়ে অভাবগ্রস্তদের আবেদনসহ যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান।
সভায় এমপি আবদুর রহমান বদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের জন্য জনগণের কাছে দোয়া কামনা করেন।
উল্লেখ্য এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্ব ২০১৪ গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপির উপস্থিতিতে সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারীদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে আগ্রাবাদের সড়ক ও জনপথ বিভাগের মাঠে কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বদিউজ্জামানকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আপনিও বদি আমিও বদি। দুর্নীতি আপনি করেছেন, না আমি করেছি তার প্রমাণ দিয়েছে আমার এই আজকের সম্মাননা। আমার মতো সাদা মনের মানুষকে কালো মনের মানুষ বানাইছেন। আর কালো মনের মানুষদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আপনি সাদা মনের মানুষ বলেছেন। ভাবছেন আমরা কিছু জানি না। সব জানি, আপনি সাবধান হয়ে যান, অন্যথায় সব ফাঁস করে দেবো।’ আলোচিত-সমালোচিত বদির বক্তব্য শুনে উপস্থিত অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন।
পাঠকের মতামত: