ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

শাহপরীর দ্বীপের ভাঙা বেড়িবাঁধের কাজ করবে সেনাবাহিনী!

saint-m নিউজ  ডেস্ক :::

গত ১৬ বছরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার একরের চিংড়িঘের ও ফসলি জমি সাগরগর্ভে তলিয়ে গেছে। বিলীন হয়েছে মসজিদ-মাদ্রাসাসহ অন্তত চার হাজার ঘরবাড়ি। জোয়ার-ভাটার কবলে পড়ে চার বছর ধরে এলাকার প্রায় তিন হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন বন্ধ আছে। ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে দ্বীপের লোকজনকে কয়েক বছর ধরে পানিবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সমস্যা-সংকটে এভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন জনপদে পরিণত হতে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শাহপরীর দ্বীপ। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপে প্রায় ৪০ হাজার লোকের বসবাস। পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠতে পারে যে দ্বীপ, সেটির সংকট সমাধানে যথাযথ নজর নেই কর্তৃপক্ষের।

চার বছর ধরে দ্বীপের পশ্চিমাংশের প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙা। বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে বিলীন হয়েছে ১৩ কিলোমিটারের ‘শাহপরীর দ্বীপ-টেকনাফ’ সড়কের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। ফলে চার বছর ধরে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ। শাহপরীর দ্বীপের লোকজনকে জোয়ারের সময় লবণের মাঠ ও ফসলির জমির ওপর নৌকায় এবং ভাটার সময় ভাঙা সড়কের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে টেকনাফ শহরে যাতায়াত করতে হচ্ছে।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ও শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা হামিদুর রহমান বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে এই দ্বীপের পশ্চিমপাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যায়। সময়ে সময়ে ভাঙা বাঁধ সংস্কারের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৭ কোটি টাকা। তবে এখন পর্যন্ত ভাঙা বাঁধে জোড়া লাগেনি।

সরেজমিন শাহপরীর দ্বীপ
১৪ মার্চ সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় ১৩ কিলোমিটারের টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ পাকা সড়কের দক্ষিণাংশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের মাঝে চারটি কালভার্ট ভেঙে গেছে। দ্বীপের মানুষ সড়কের দুপাশে জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকা লবণ চাষের মাঠের ওপর নৌকা নিয়ে চলাচল করছে। সড়কের কয়েক শ গজ পশ্চিমে দেখা যায়, পাউবোর ভাঙা বেড়িবাঁধ। এই ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে। ভাটার সময় আবার সেই পানি সাগরে নেমে যাচ্ছে। প্রতিদিনের দুবার জোয়ার-ভাটার কবলে বিপর্যস্ত হচ্ছে দ্বীপের পশ্চিমপাড়া, ঘোলাপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার শত শত দরিদ্র মানুষ।

শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা ও উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম এ হাশেম বলেন, গত ১৬ বছরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে এই শাহপরীর দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার একরের চিংড়িঘের ও ফসলি জমি সাগরগর্ভে তলিয়ে গেছে। বিলীন হয়েছে, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ অন্তত চার হাজার ঘরবাড়ি। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে শাহপরীর দ্বীপ-টেকনাফ সড়কটি বিলীন হওয়ায় লোকজনকে ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় টেকনাফ আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে।

পশ্চিমপাড়ার লবণচাষি কেরামত উল্লাহ বলেন, জোয়ার-ভাটার কারণে চার বছর ধরে এলাকার প্রায় তিন হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন বন্ধ আছে। এতে পাঁচ শতাধিক লবণচাষির পরিবার অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছে।

উত্তরপাড়ার সংবাদকর্মী জসিম উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভাটার সময় যখন নৌচলাচল বন্ধ হয়, তখন এলাকার মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়।

ভাঙা সড়ক সংস্কার প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া বলেন, আগে ভাঙা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বাঁধের আগে সড়ক সংস্কার করা হলে জোয়ারের ধাক্কায় তা আবার ভেঙে যাবে।

ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে এলাকাবাসী পানিবন্দী হয়ে পড়ে বলে মন্তব্য করলেন শাহপরীর দ্বীপ আওয়ামী লীগের সভাপতি সোনা আলী। তিনি বলেন, দ্বীপের লোকজনকে কয়েক বছর ধরে পানিবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার মানুষ এলাকা ছেড়ে টেকনাফ সদরে চলে গেছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় শতাধিক শিক্ষার্থীর লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে।

শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা ও উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও এলাকার প্রবীণ শিক্ষক জাহেদ হোসেন বলেন, মৎস্য আহরণের অন্যতম স্থান শাহপরীর দ্বীপ এখন বিচ্ছিন্ন জনপদ। এপ্রিল মাস থেকে শুরু হবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মৌসুম। তখন জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবনের মুখে পড়বে হাজারো পরিবার।

কাতারের দেওয়ানি আমিরের সচিবালয়ের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ড. হাবিবুর রহমান সম্প্রতি শাহপরীর দ্বীপ ঘুরে হতাশ হন। এই দ্বীপের বাজারপাড়ায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি।

হাবিবুর রহমান বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ কিংবা সংস্কার করে শাহপরীর দ্বীপকে রক্ষা করা যাবে না। দ্বীপকে রক্ষা করতে হলে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম অংশ থেকে পূর্ব দিকে নাফ নদী পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা ‘খুরের মুখ’ নামক খালটি খুলে দিতে হবে। এতে জোয়ারের পানি খাল দিয়ে নাফ নদীতে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা হলে শাহপরীর দ্বীপ বিলীনের কবল থেকে রক্ষা পাবে। সড়ক যোগাযোগর জন্য খালের ওপরে দৃষ্টিনন্দন একাধিক সেতু তৈরি হতে পারে। তখন শাহপরীর দ্বীপ আলাদা দ্বীপ হিসেবে পর্যটক আকর্ষণ করতে পারবে।

সেনাবাহিনীকে দিয়ে বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব
পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম অংশের বিলীন ২ দশমিক ৬৪৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের পুনর্নির্মাণ কাজের জন্য প্রায় ১০৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ঠিকাদার হিসেবে এ কাজ করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আর কাজের তত্ত্বাবধান করবে পাউবো। প্রকল্পের কাজ সরাসরি ক্রয় (ডিপিএম) পদ্ধতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) অনুমোদন প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনামা দাখিল করা হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কাজের দরপত্র আহ্বান করা হবে।

বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ কখন শুরু হবে, তা জানতে চাইলে মো. সবিবুর রহমান বলেন, ২০১৯ সালের ৩০ জুনের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ জুনের আগেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব।

পাউবো সূত্র জানায়, ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়া, মাঝেরপাড়া, ঘোনারপাড়া হয়ে দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত ২ দশমিক ৬৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। এর উচ্চতা হবে সাড়ে ছয় মিটার। প্রস্থ হবে সাড়ে চার মিটার। সমুদ্রের করাল গ্রাস থেকে বেড়িবাঁধটি রক্ষার জন্য এক পাশে (সমুদ্রের দিকের অংশে) বসানো হবে পাথরের সিসি ব্লক।

পাঠকের মতামত: