মৃত ব্যক্তির পরিবারের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অমানবিক সিন্ডিকেট বাণিজ্যে মেতে ওঠেছে অ্যাম্বুলেন্সওয়ালারা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) মর্গ ঘিরেই তাদের এই বেপরোয়া বাণিজ্য। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন- দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই বাণিজ্য যেনো কিছুতেই থামার নয়। কারণ, এই সিন্ডিকেট বাণিজ্যে জড়িত রাঘব বোয়ালরা। এর মধ্যে চিকিৎসক নেতাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের নামও শোনা যায়। আর রাঘব বোয়ালদের কল্যাণেই এই সিন্ডিকেটের হাত মন্ত্রণালয় পর্যন্ত প্রসারিত বলেও প্রচার রয়েছে। ফলে লাশ পরিবহন নিয়ে দিনের পর দিন অ্যাম্বুলেন্সওয়ালাদের এই অমানবিক বাণিজ্য চলে আসলেও সেটি থামানো যাচ্ছেনা। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টদের। লাশ পরিবহন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সওয়ালাদের বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছেন চমেক প্রশাসন ও চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মৃত ব্যক্তির অসহায় পরিবার ও ভুক্তভোগীদের এ জিম্মি দশা থেকে মুক্তি দিতে তারা অপারগ! তাঁরা বলছেন- অ্যাম্বুলেন্সওয়ালাদের এই বাণিজ্য থামানো বা নিয়ম-নীতির মধ্যে আনার বিষয়টি তাদের (কতৃপক্ষের) আয়ত্বে নেই।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়- অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পোস্ট মর্টেমের জন্য লাশের ঠিকানা হয় চমেক মর্গ। সেখানে পোস্ট মর্টেম শেষে লাশ বহনের জন্য প্রয়োজন পড়ে অ্যাম্বুলেন্সের। এসময় পরিবারের সদস্যকে হারিয়ে এমনিতেই অসহায় পরিস্থিতিতে থাকেন মৃত ব্যক্তির পরিবার ও স্বজনরা। আর মৃত ব্যক্তির পরিবারের এই অসহায়ত্বকেই পুঁজি করেন অ্যাম্বুলেন্সওয়ালারা। লাশ বহনের ক্ষেত্রে ইচ্ছে মতো ভাড়া দাবি করে বসেন তারা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ-এক্ষেত্রে চালকদের দাবিকৃত ভাড়াতেই লাশ বহনে রাজি হতে বাধ্য করানো হয়। কারণ, এই লাশ বহনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন ভাড়ার তালিকা নেই। আর সমিতির বাইরের কোন অ্যাম্বুলেন্স করেও লাশ বহন করতে দেয়া হয়না। মোট কথা- এ যেনো অ্যাম্বুলেন্স সমিতির নৈরাজ্য। যা অমানবিক বলে আখ্যা দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন। তাঁরা বলছেন- বিষয়টি অবশ্যই অমানবিক। কোন নিয়ম-নীতি ছাড়া লাশ বহনে এভাবে ইচ্ছে মাফিক ভাড়া আদায়ে বাধ্য করা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি মৃত ব্যক্তির পরিবারের প্রতি এক প্রকার অবিচার।
যদিও ভাড়ার তালিকা রয়েছে বলে দাবি অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন- ভাড়া নির্ধারণ করে একটি তালিকা আছে। তবে সেটা কিলোমিটার হিসেবে নয়, এলাকা ভিত্তিক। অর্থাৎ তারা কিলোমিটার প্রতি হিসেব না করে এলাকা ভিত্তিক একটি মনগড়া ভাড়ার তালিকা করেছেন। তাও অফিসেই দেয়ালবদ্ধ! বাইরের কারও এ তালিকা দেখার সুযোগ নেই।
সমিতি সূত্রে জানা গেছে- মর্গ থেকে লাশ বহনের পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি। সমিতির অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা ১৩০-এর কিছু কম-বেশি। আনোয়ার হোসেন লিটন সমিতির সভাপতি। আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন আকতারুজ্জামান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন লিটন। ব্যস্ততার কথা বলে তিনি সাধারণ সম্পাদকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। আর সাধারণ সম্পাদক আকতারুজ্জমানের মুঠোফোনে বেশ কয়বার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেন নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, ভাড়ার তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু সেটি কিলোমিটার হিসেব করে নয়। এলাকা ভিত্তিক। তবে সে-ই তালিকাটিও কেবল অফিসেই টাঙানো থাকে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর ‘চমেক মর্গ যেনো দালালের স্বর্গরাজ্য, লাশ নিয়ে চলে অমানবিক বাণিজ্য’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন (২২ অক্টোবর, ২০১৪) চমেক হাসপাতালের মর্গে দালালদের দৌরাত্ম্য ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে চট্টগ্রামের একটি আদালত সুয়োমোটো রুল (সুয়োমোটো পিটিশন মামলা নং- ০১/২০১৪) জারি করেন। রুলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালত-২ এর তৎকালীন বিচারক মোহাম্মদ রহমত আলী স্ব-প্রণোদিত হয়ে এ নির্দেশ দেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ (১) (গ) ধারার ক্ষমতাবলে বিচারক সিআইডির পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তে বেশ কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। সব শেষে প্রায় দুই বছরের মাথায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর (২০১৬) এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন সিআইডি মেট্রো জোনের সহকারি পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির সরকার। এর আগে বিষয়টি তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান চৌধুরী, সিআইডির সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার হ্লা চিং প্রু এবং সিআইডির সহকারি পুলিশ সুপার এস এম সাহাবুদ্দিন।
প্রতিবেদনে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নিয়ে বাণিজ্যের বিষয়টি প্রতীয়মান হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে (আমলী আদালত নং-৩) প্রদত্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়- অ্যাম্বুলেন্সের মালিকগণ একজোট হয়ে ‘চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি’ (রেজি: নং- ১১২৯২) গড়ে তুলেছেন। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার শাহনাজ ম্যানশনে সমিতির অফিস স্থাপন করা আছে। এই সমিতির মাধ্যমে সকল অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রিত হয় উল্লেখ করে সিআইডি’র সহকারি পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির সরকার প্রদত্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- যখনই কোনো অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন হয়, তাহাদের সমিতির বাহির হইতে কেহ অ্যাম্বুলেন্স নিতে সক্ষম হয়না। এক্ষেত্রে বাহির হইতে অ্যাম্বুলেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে তাহাদের বাঁধাও রহিয়াছে। এই সুযোগে তাহারা ইচ্ছে মাফিক ভাড়া নির্ধারণ করিয়া দেয়, যাহা ভূক্তভোগী লোকজন মানিয়া নিতে বাধ্য হন। ফলে লোকজন ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হইয়া আসিতেছে বলিয়া তদন্তকালে প্রকাশ পায়। ভুক্তভোগীদের এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে একাধিক প্রস্তাবনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রস্তাবনায় বলা হয়- ‘অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি কতৃক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ ও গন্তব্যের ভাড়া র্নিধারণ পদ্ধতি চালু থাকার কারণে ভূক্তভোগীরা ব্যাপক ভাবে আর্থিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হইতেছে। এক্ষেত্রে হয় কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা প্রয়োজন, নয়তো প্রতিযোগিতা মূলক খোলা মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। মালিক সমিতি কোন বিধি বলে ইচ্ছে মাফিক অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নির্ধারণ করিয়া ভূক্তভোগীদের অ্যাম্বুলেন্স নিতে বাধ্য করিতেছে তাও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে সিআইডির প্রতিবেদনে। অ্যাম্বুলেন্সওয়ালাদের এই সিন্ডিকেট বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন আজাদীকে বলেন- বিষয়টি আমরাও জানি। এটি কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু মর্গটা হাসপাতালের নয়- মেডিকেল কলেজের। এ নিয়ে হাসপাতালের পক্ষ থেকে কিছু করার নেই। রোগী বহনের জন্য চমেক হাসপাতালের ৫টি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও লাশ বহনের কোন অ্যাম্বুলেন্স নেই বলেও জানান হাসপাতাল পরিচালক।
আর লাশ বহন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সওয়ালাদের এই বাণিজ্য অমানবিক হিসেবে দেখছেন চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সেলিম মো. জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন- কিন্তু এটি নিয়ে আমাদেরও কি করার আছে। আমাদের লাশ বহনের কোন অ্যাম্বুলেন্স নেই। তবে অ্যাম্বুলেন্সওয়ালাদের বাণিজ্য ঠেকাতে হলে সিআইডি’র প্রস্তাবনায় একমত প্রকাশ করেন কলেজ অধ্যক্ষ। তিনি বলেন- কিলোমিটার প্রতি হিসেব করে ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে। নয়তো ওপেন মার্কেট সিস্টেম করে দিতে হবে। মৃত ব্যক্তির পরিবার যে কোন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে লাশ বহন করবে। এতে কেউ বাধা দিতে পারবে না। এ কাজগুলো কে করবে এমন প্রশ্নের উত্তরে কলেজ অধ্যক্ষের জবাব- এটি বিআরটিএ ও মাইক্রোবাস সমিতি নির্ধারণ করতে পারে। কারণ, মর্গ থেকে লাশ বের করার পর রাস্তায় আর আমাদের এখতিয়ার থাকেনা।
কলেজ কর্তৃপক্ষ লাশবাহী কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে কিনা জানতে চাইলে প্রফেসর সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন- বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের। এমন সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ই নিতে পারে। আর কলেজ কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারে কিনা জানতে চাইলে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনটি পেলে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বললেন চমেক অধ্যক্ষ।
পাঠকের মতামত: