ঢাকা,বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

রাবার শিল্প হুমকীর মুখে

Ramu-Rabar-Pic-1কক্সবাজার প্রতিনিধি :::

বছর বছর উৎপাদন বাড়লেও বাজারে রাবারের দাম অর্ধেকে নেমে আসায় দেশের প্রথম মাতৃবাগান কক্সবাজারের রামু রাবার বাগানকে গত দুই বছর ধরে বছরে কোটি টাকারও বেশী লোকসান গুনতে হচ্ছে। শুধু রামু রাবার বাগান নয়, কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে দেশের সরকারী ১৮টি রাবার বাগান এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ফলে হুমকীর মুখে পড়েছে দেশের রাবার শিল্প।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারী ১৮টি বাগানসহ বর্তমানে দেশে যে পরিমান রাবার উৎপাদন হয় তা দিয়ে দেশের চাহিদার ৬০ ভাগ মেটানো সম্ভব হলেও বিদেশ থেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রাবার আমদানী করা হচ্ছে। অন্যদিকে রাবার আমদানীতে নামমাত্র আমদানী শুল্ক বসানো এবং কৃষিপণ্য হলেও রাবার বেচার সময় শতকরা ১৫ টাকা ভ্যাট ও ৪ টাকা আয়কর চাপিয়ে দেওয়ার কারণই দেশের রাবার শিল্পের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।

জানা গেছে, দেশে কাঁচা রাবারের স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে কক্সবাজারের রামুর জোয়ারিয়ানালা এলাকায় গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম মাতৃ রাবার বাগান । মালয়েশিয়া থেকে বীজ এনে শুরুতে মাত্র ৩০ একর জমিতে এ বাগান গড়ে তোলা হলেও বর্তমানে এ বাগানের আয়তন ২ হাজার ৬৮২ একর। বর্তমানে এ বাগানে রয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৬১৬টি গাছ। এর মধ্যে উৎপাদনশীল গাছের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৫৬৮টি।

সরেজমিনে দেখা গেছে,বাগানের হাজার হাজার গাছে ঝুলছে ছোট ছোট মাটির পাত্র। সেই পাত্রে কাটা অংশ দিয়ে গাছ বেয়ে বেয়ে পড়ছে ধবধবে সাদা দুধের মতো রাবারের কষ। পাত্রে জমা হওয়া রাবারের কষ সংগ্রহ করে শ্রমিকেরা ভার করে আবার দুরবর্তী স্থানের কষ গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কারখানায়।

বাগানের মাঠ তত্ত্বাবধায়ক আবুল হুদা জানান, মূলত সারা বছরই রাবার উৎপাদন চলে। তবে অক্টোবর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত চারমাস রাবার উৎপাদনের ভর মৌসুম। মৌসুমে প্রতিদিন রামু রাবার বাগান থেকে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার কেজি কষ আহরন করা হয়। শীতে কষ আহরণ বেশী হয়,আবার বর্ষায় উৎপাদন কমে আসে। এসব কষ আহরণে নিয়োজিত রয়েছে নিয়মিত অনিয়মিত প্রায় ২২০ জন শ্রমিক।

আর বাগান থেকে সাদা কষ সংগ্রহের পর ৭দিনের মধ্যে তা প্রকৃয়াজাত করে শুকনো রাবারে পরিণত করার কথা জানালেন বাগানের কারখানা তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আনোয়ার ।

তিনি জানান,বাগান থেকে কষ সংগ্রহ করে কারখানায় আনার পরে কষগুলো নিদির্ষ্ট পাত্রে ঢালা হয়। এর পর কষের সঙ্গে পানি ও এসিড মিশিয়ে নির্ধারিত স্টিলের ট্যাং-এ জমা রাখা হয়। সেখানে আলাদা প্লেট বসিয়ে কোয়াগোলাম বা রাবার সিটে পরিণত করা হয়। এরপর রোলার মেশিনের সাহায্যে কষ থেকে পানি বের করে ড্রিপিং শেডে শুকানো হয়। পরে ধুমঘরে তা পোড়ানো হয়। ওই প্রকৃয়া শেষে রাবার ৫০কেজি ওজনেরবান্ডিল করে বস্তাভর্তি করে গুদামজাত করা হয়। তিনি জানান,বাগান থেকে কষ এনে শুকনো রাবার সিটে পরিণত করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ সাতদিন। এভাবে মৌসুমে প্রতিদিন এ বাগান থেকে ৩০ থেকে ৩৫ মেট্রিকটন শুকনো রাবার উৎপাদন করা হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

রামু রাবার বাগান কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে এবাগানে উৎপাদন হয়েছে ১লাখ ৬১ হাজার ২১৭ কেজি রাবার। সে বছর লাভ হয়েছে ৫২লাখ,৮৩ হাজার,৪৪৮ টাকা। ১৩-১৪ অর্থ বছরে উৎপাদন-১ লাখ ৬৭ হাজার ১৫১ কেজি,১৪-১৫ অর্থ বছরে-১ লাখ ৬৮ হাজার ৪৪ কেজি এবং ১৫-১৬ অর্থবছরে মাত্র ৬ মাসেই উৎপাদন হয়েছে ১লাখ ১১হাজার কেজি রাবার।

রামু রাবার বাগানের উপ-ব্যবস্থাপক মো.ওয়াহিদুল ইসলাম জানান,চট্টগ্রাম জোনে ৯টি,টাঙ্গাইল-ময়মংসিংহে ৫টি,সিলেটে-৪টিসহ বর্তমানে দেশে মোট ১৮টি সরকারী রাবার বাগান রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দাঁতমারা রাবার বাগানটি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়। সবকটি বাগানেই বছর বছর রাবারের উৎপাদন বাড়ছে এবং এসব বাগান থেকে বর্তমানে বছরে অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিকটন রাবার উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারীভাবেও গড়ে ওঠেছে অসংখ্য রাবার বাগান। তিনি বলেন, সরকারী বাগানসহ দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ রাবার উৎপাদন হচ্ছে তা দিয়ে দেশের ৬০ভাগ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু বছর বছর উৎপাদন বাড়লেও উপযুক্ত বাজার দর না পাওয়ায় রাবার শিল্প এখন হুমকীর মুখে।

তিনি জানান, প্রতিকেজি রাবার উৎপাদনে ১৮৮ টাকা খরচ পড়লেও বর্তমানে বাজার দর পাওয়া যাচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। এ অবস্থা চলতে থাকায় ১২-১৩ অর্থবছরের পর থেকে শুধুমাত্র রামু রাবার বাগানে বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। শুধু এ বাগানই নয়,বর্তমানে কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে দেশের সরকারী ১৮টি বাগানই বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বেসরকারী বাগানগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।

এদিকে গত কয়েক বছর ধরে রাবার শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসায় রামু রাবার বাগানের প্রায় দুই শতাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানান বাগানের মাঠ তত্ত্বাবধায়ক আবুল হুদা। তিনি জানান, দেশের ১৮টি সরকারী রাবার বাগানে কর্মরত আছেন সারা দেশের প্রায় সাড়ে ১০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে এসব মানুষের জীবিকা নির্বাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

তবে আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং শুকনো রাবারের উপর ভ্যাটও আয়কর চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই এ রাবার শিল্পে বিপর্যয়ের মূল কারণ বলে তিনি মন্তব্য করেন রামু রাবার বাগানে উপ ব্যবস্থাপক মো.ওয়াহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন,নামমাত্র আমদানি শুল্ক বসানোর কারণে আমদানিকারকেরা বিদেশ থেকে চাহিদার তুলনায় বেশী রাবার আমদানী করছে। ফলে দেশীয় রাবারের চাহিদা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিপণ্য হলেও শুকনো রাবার বেচার সময় সরকার ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট ও ৪ পার্সেন্ট আয়কর পরিশোধ বাধ্যতামূলক করেছে। সরকারের এ ধরনের সিদ্বান্ত বর্তমানে রাবার শিল্পের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় হিসাবে দাঁড়িয়েছে। তাই ১৯৬০ সাল থেকে টিকে থাকা এশিল্পকে বাঁচাতে আমদানি শুল্ক বাড়ানো এবং রাবারের উপর ভ্যাট ও আয়কর প্রত্যাহার করার দাবি জানান তিনি।

পাঠকের মতামত: