ঢাকা,বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০২৪

মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত: জাতিসংঘ

rohinga2বিদেশ ডেস্ক:
রাখাইন রাজ্যে বিবিসির এক প্রতিনিধি দেখা পেয়েছিলেন এই দুই রোহিঙ্গা নারীর। একজন জানিয়েছেন, তার স্বামীকে সেনারা হত্যা করেছে। অন্যজনের স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে।মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন এবং সহিংসতার ভয়ঙ্কর সব সাক্ষ্য প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া এক নারী জাতিসংঘের তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তাকে যখন ধর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখন তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে এসে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল। তখন হামলাকারীদের একজন তার মেয়েকে ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে।

শুক্রবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দফতর বলেছে, রাখাইনে যা ঘটছে তা সম্ভবত মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর দায়িত্ব মিয়ানমারকে নিতে হবে।

এ ধরনের আরও ভয়ঙ্কর সব ঘটনার সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের কর্মকর্তারা। তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসা দুই শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমের সঙ্গে কথা বলেছেন।

রিপোর্টে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সাক্ষ্যদানকারী রোহিঙ্গারা সেখানে হত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের অনেক সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন।

অর্ধেকের বেশি নারী বলেছেন, তারা ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা একদল রোহিঙ্গা শরণার্থী

সাক্ষ্যদানকারী রোহিঙ্গারা আরও জানিয়েছেন, সেখানে অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের সবাইকে তাদের বাড়িতে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের স্কুল, মসজিদ, ক্ষেতের ফসল এবং গবাদি পশু।

মিয়ানমার সরকার অবশ্য বরাবরই এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে। দেশটির দাবি, ‘সন্ত্রাসী’দের খুঁজতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে। সংঘাতকবলিত এলাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চলমান জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে জীবন বাঁচাতে রাখাইন রাজ্যের হাজার হাজার রোহিঙ্গার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ সীমান্তে। মাথায় একটাই চিন্তা; কিভাবে নরককুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা যায়? সেই নরক থেকে বেরিয়ে আসা একজন লালু বেগম। তার ভাষায়, ‘১০ বছরের অধিক বয়সের কোনো বালককে পেলেই তারা তাদের হত্যা করে। পুরুষদের সেনাবাহিনীর গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই নারী জানান, তাদের সম্প্রদায়ের নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হচ্ছে।

লালু বেগম ‘সেনাবাহিনী যখন আসে তখন আমরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আমি জানি না আমার স্বামী জীবিত আছেন নাকি তিনি মৃত।’

বর্তমানে কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকায় অবস্থান করছেন লালু বেগম। তিনি সিএনএনকে জানান, তার গ্রামের বহু নারী সরকারি সেনাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।

লালু বেগম বলেন, ‘তারা যখন কোনও সুন্দর নারী দেখে তখন তারা তাদের কাছে পানি চায়। এরপর তারা ঘরে ঢুকে তাদের ধর্ষণ করে।’

রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গার বাস। জাতিসংঘের ভাষায় এরা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। এমনকি বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে সেখান বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত প্রদান করে না মিয়ানমার সরকার।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে রাজি নয়। তারা এ সম্প্রদায়ের মানুষদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ বহু মানুষই মিয়ানমারে তাদের পূর্বপুরুষদের শিকড় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

লালু বেগম বলেন, ‘আমাদের গ্রাম যখন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তখন আমরা অন্য গ্রামে চলে যাই। অব্যাহতভাবে অবস্থান বদলাতে থাকি। এভাবে আসতে আসতে আমরা নদীতীরে আসি।’

তিনি বলেন, এই আসার পথে অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন।

স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবিতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের দুটি গ্রামে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর তাণ্ডবের আগের ও পরের চিত্র। ছবি: এইচআরডব্লিউ।

লালু বেগমের ভাবী নাসিমা খাতুন সিএনএনকে বলেন, ‘যাত্রা শুরু করার সময়ে আমরা ছয়জন ছিলাম। আমরা পরিবারের তিন সদস্যকে হারিয়েছি। আমার স্বামী ও এক পুত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আরেক পুত্র নিখোঁজ রয়েছে।’

জাতিসংঘ শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তা জন ম্যাককেসিক বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর ‘যৌথ নিপীড়ন’ চালাচ্ছে।

জাতিসংঘের দাফতরিক সংজ্ঞা অনুযায়ী এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নিধন হলো সেই প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে ‘হুমকি দিয়ে অথবা শক্তি প্রয়োগ করে কোনও একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে কোনও জাতিগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নির্মূল করে অপর কোনও জাতির একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।’ আর তাদের হত্যা-ধর্ষণ-শিশু নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ ওই নির্মূল প্রক্রিয়ারই অংশ।

জাতিসংঘের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে মিয়ানমার সরকারের মদদপুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের তাণ্ডবে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হন। ঘর ছাড়তে বাধ্য হন ১ লাখেরও বেশি মানুষ। আর এ বছর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইসলামি চরমপন্থা দমনে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন তারা। আর তা এমন কঠোর প্রক্রিয়ায় চালানো হচ্ছে যে সেখানে সংবাদমাধ্যমকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

জন ম্যাককিসিক বিবিসিকে বলেন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে ‘মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে, শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে, লুটপাট চালাচ্ছে, নদী পেরিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে’।

তিনি বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বলা খুব কঠিন যে তারা সীমান্ত উন্মুক্ত করে রেখেছে। কেননা এতে মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধন প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্তিত করা হবে। চূড়ান্ত অর্থে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা হত্যাকাণ্ড এবং তাদের বিতাড়ন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবে।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, সিএনএন।

পাঠকের মতামত: