ঢাকা,বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪

ভেজাল ওষুধে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীরা অসহায়

medicinনিউজ ডেস্ক :::

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. জাকারিয়া স্বপন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কেমোথেরাপির আওতায় আছেন। থেরাপির এক ধাপে তিনি দেখেন, তাঁর কাঙ্ক্ষিত শারীরিক উন্নতি হয়নি। তিনি নিজেই বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখতে পান, তাঁর শরীরে যে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটি আসল ছিল না। তাই তাঁর ক্যান্সারের মাত্রা বেড়ে গেছে। ঢাকার একটি বড় হাসপাতালে কেমোথেরাপি নিতে গিয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের ওই ভেজাল বা নকল ওষুধ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন সরকারের ওষুধ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে। এ ছাড়া তিনি আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।

অধ্যাপক ডা. জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘যে নামকরা হাসপাতালে আমার কেমোথেরাপি চলছিল, সেখানে গত ১০ ও ১৭ ডিসেম্বর যে ওষুধের দুটি ডোজ আমাকে দেওয়া হয়, তা আসল ছিল না। ফ্রান্সের একটি কম্পানির ওষুধ নকল করে দেওয়া হয়েছিল। ওই ওষুধে যে সাইটোটক্সিন উপাদান থাকার কথা ছিল তা না থেকে অন্য কিছু দেওয়া ছিল। অথচ এ ওষুধের প্রতিটি ডোজের দাম রাখা হয় প্রায় ১৮ হাজার টাকা করে।

কুষ্টিয়া থেকে এক কলেজ ছাত্রী ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালের একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। ওই চিকিৎসক তাঁকে একটি ওয়েন্টমেন্ট (মলম) ব্যবহার করতে দেন। ওই ছাত্রী ঢাকার পল্টন এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে বিদেশি একটি কম্পানির ওই ওষুধ কিনে ব্যবহার শুরু করেন। কিন্তু তিন দিনের মাথায় তাঁর মুখমণ্ডলের চামড়া কুঁচকে কালো হতে থাকে। স্বজনরা দ্রুত তাঁকে আবার নিয়ে যান সেই চিকিৎসকের কাছে। সব দেখেশুনে চিকিৎসক জানান, মলমটি আসল না। বিদেশি কম্পানির নামে এটা নকল করে বাজারে ছাড়া হয়েছে, যার শিকার হয়েছে এই রোগী।

এভাবে নকল বা ভেজাল ওষুধে যেমন দেশের বাজার ছেয়ে আছে, তেমনি আবার এসব ওষুধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থাও নেই দেশে। শুধু মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে ভেজাল বা নকল বা অনুমোদনহীন বা নিষিদ্ধ ওষুধ জব্দ করে, দুই-একজনকে সাজা দিয়ে দায় সারছে সরকার। কিন্তু ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতিকর ওষুধ বাজারে ছাড়া হয় বা কতসংখ্যক রোগী তা ব্যবহার করে কে কী ক্ষতির মুখে পড়ছে, তা খতিয়ে দেখা হয় না। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলার কোনো ব্যবস্থাও কেউ নেয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নকল-ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধের দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি এসব ওষুধে ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলার দায়িত্বও নিতে হয় রাষ্ট্রকে। নকল বা ভেজালকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে আদায় করা জনিমানার অর্থ দিয়েও রাষ্ট্র সেটা করতে পারে। কিন্তু সে রকম উদ্যোগ এ দেশে নেই। তাই ভেজাল বা নকল ওষুধ সেবন বা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীরা পড়েন অসহায় অবস্থায়।

মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলে কিছুদিন আগে দেশের বড় বড় বেশ কিছু ওষুধ কম্পানির প্রচলিত প্যারাসিটামল ও ডায়াবেটিসের ওষুধ নিষিদ্ধ করে তা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি গাজীপুরে ব্রিস্টল ফার্মা লিমিটেডে অভিযান চালিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও র‌্যাব বিভিন্ন অনুমোদনহীন ওষুধ জব্দ ও কম্পানিকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে। আরো কয়েক দিন আগে র‌্যাবের অভিযানে মহাখালী এলাকায় পিনাকল সোর্সিং লিমিটেড, হলি ড্রাগস ল্যাবরেটরিজ, হলি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড ও জি কে ফার্মা থেকে বিভিন্ন ধরনের ১১ লাখ ৮০ হাজার পিস ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল এবং এক লাখ তিন হাজার বোতল নকল, অনুমোদনহীন ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়। জানা যায়, জি কে ফার্মা ৫৬ ধরনের ওষুধ অবৈধভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওই অভিযানে কর্মকর্তাদের জেল-জরিমানা করে প্রতিষ্ঠানগুলো সিলগালা করা হয়।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে মোবাইল কোর্টের অভিযানের সময় এক হাজার ১৮৯টি মামলা দেওয়া হয় অবৈধ, ভেজাল বা চোরাই ওষুধ বিক্রি, সংরক্ষণ, আমদানি ও উৎপাদনের অভিযোগে। এ সময় ৩১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১২টি কারখানা, ৪৪টি ফার্মেসি ও দুটি গোডাউন সিলগালা করা হয়। একই সঙ্গে ২২ কোটি ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৪০০ টাকার মন্দ ওষুধ জব্দ করা হয়। কিন্তু একবার সাজা বা বন্ধ করে দেওয়া হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান পরে আবার একই অপরাধে লিপ্ত হয়, এমন নজিরও পাওয়া যায়।

কিন্তু মন্দ ওষুধ আটকের আগে যেসব রোগী দোকান থেকে তা কিনে দিনের পর দিন সেবন বা ব্যবহার করেছে, তাদের ক্ষতি নিরূপণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন করে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেই দেশে। ফলে ভেজাল ওষুধে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের সুরক্ষার বিষয়টি বরাবরই চাপা পড়ে থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত এডিআর (অ্যাডভার্স ড্রাগ রিঅ্যাকশন) নিরূপণ পদ্ধতি অনুসরণে বাংলাদেশে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আওতায় একটি কার্যক্রম থাকলেও তা পর্যাপ্ত মাত্রায় কার্যকর নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন এই এডিআর নিয়ে কোনো জানাশোনা নেই, তেমনি সরকারের তরফ থেকেও এটি কার্যকর করার তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। অবশ্য এর পেছনে অসাধু ওষুধ কম্পানিগুলোর কারসাজির কথা বলছেন কেউ কেউ।

বনানী এলাকার একটি ওষুধের দোকানের এক বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ওষুধ কম্পানির লোকজন এসে আমাদের ওষুধ দিয়ে যায়। অনেকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়েই এসব ওষুধ কিনতে আসে আবার অনেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এসে ওষুধ নিয়ে যায়। তাই আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি না, রোগীদের আমরা কোনো খারাপ ওষুধ দিচ্ছি কি না। ওই ক্রেতাদের খোঁজ রাখার কোনো পদ্ধতি বা উপায় নেই।

ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, এ দেশের মানুষ ওষুধের ক্ষতির ব্যাপারে সচেতন নয়। ফলে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও তা অন্যকে জানাতে বা অন্যকে ওই ক্ষতি থেকে রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে কেউ এগিয়ে আসে না। আর সরকারের তরফ থেকে তো এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখাই যায় না। ফলে দেশে নকল, ভেজাল, নিষিদ্ধ, অনুমোদনহীন বা নিম্নমানের ওষুধের বাণিজ্য চলছেই। শুধু অভিযান চালিয়ে এ অবস্থা থেকে মানুষকে রক্ষা করা মুশকিল।

এই ওষুধ বিশেষজ্ঞ উদাহরণ দিয়ে বলেন, সত্তরের দশকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলে তৎকালীন সিবা গেইগির তৈরি আমাশয়ের একটি ওষুধ খেয়ে মানুষের মধ্যে স্মন নামের এক রোগ দেখা দেয়। এতে শরীর ঝিনঝিন করত এবং একপর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেত। বাংলাদেশে তখন রোগটি ছড়িয়ে পড়ে ঝিনঝিন রোগ নামে। ওই সময় জাপানে স্মনে আক্রান্তদের পক্ষ থেকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুবাদে সেখানে সিবা গেইগিকে ১২ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয় এবং আদালতের নির্দেশে রাষ্ট্র সেই অর্থ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের খুঁজে বের করে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়। অথচ বাংলাদেশে এক পয়সাও দিতে হয়নি ওই কম্পানিকে। এখানে কেবল বিষাক্ত প্যারাসিটামল খেয়ে মৃত্যুর কারণে কয়েকজনের সাজা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব বলেন, ডাক্তারদের মধ্যে এডিআর মনিটরিংয়ের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তেমন সচেতনতা তৈরি করা যায়নি। ফলে এডিআরের রিপোর্টিং নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই ডাক্তারদের মধ্যে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক-চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বেশির ভাগ চিকিৎসকই রোগীকে যে ওষুধ দিলেন, তাতে রোগীর কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতি হলো তা নিয়ে মাথা ঘামান না। বরং এ নিয়ে রোগীর দিক থেকে কোনো প্রশ্ন তোলা হলে তাদের উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে নিজের দায় এড়িয়ে যান। কোনো কোনো চিকিৎসক আবার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বুঝতে পারলে রোগীর অজান্তেই দ্রুত ওষুধ পাল্টে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ধরে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশেও একটি এডিআর মনিটরিং সেল গঠন করা হয়। পরে এর একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিছু প্রচার-প্রচারণাও চলে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। তবে সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ৩০টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এডিআর মনিটরিং সেল কার্যকর আছে। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশের সব ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে এডিআরের আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৩ সালে এডিআর মনিটরিং সেলটি আরো শক্তিশালী করতে ইউএসএআইডির পক্ষ থেকে সহযোগিতাও করা হয়।

জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন এডিআর মনিটরিং ব্যবস্থা অনেক বেশি কার্যকর। অনেক প্রতিবেদন আমরা নিয়মিত পাচ্ছি। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। নকল-ভেজাল ওষুধে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীরা আমাদের ওয়েবসাইট থেকে নির্দিষ্ট ফরমে অভিযোগ জানাতে পারেন। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরাসরি আমাদের দিক থেকে তেমন কিছু করার নেই।’

একই অধিদপ্তরে এডিআর মনিটরিংবিষয়ক দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘প্রতি মাসে আমাদের কাছে ৩০-৪০টি প্রতিবেদন আসে। আমরা সেগুলো গাইডলাইন অনুসারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ সেলে পাঠিয়ে দিই। তাদের নির্দেশনা অনুসারে পরবর্তী সময়ে জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। এভাবেই সম্প্রতি বেশ কিছু কম্পানির প্যারাসিটামল ও ডায়াবেটিসের কয়েকটি ওষুধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, প্রস্তাবিত জাতীয় ওষুধনীতিটি এখনো মন্ত্রণালয়ে ঝুলছে। এটি অনুমোদন ও বাস্তবায়নের পর্যায়ে গেলে এ ধরনের সমস্যা কিছুটা হলেও কমবে। এডিআর আরো কার্যকর করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘রোগীর সুরক্ষায় নতুন আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। এটি করা গেলে কেবল চিকিৎসা সংক্রান্তই নয়, ওষুধের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের সুরক্ষাও নিশ্চিত হবে বলে আশা রাখছি।’

পাঠকের মতামত: