এম.আর মাহমুদ :
অবশেষে মেয়াদ পূর্তির পর এবার নতুনভাবে দলীয় প্রতীকে সারাদেশে পৌর ও ইউপি নির্বাচন দেখার সৌভাগ্য হবে আমজনতার। অতীতে দেশের মানুষ দলীয় প্রতীকে সংসদ নির্বাচন দেখলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেখেনি। বর্তমান সরকারের বদান্যতায় এবার দলীয় প্রতীকে পৌর ও ইউপি নির্বাচন দেখবে। যা গত সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দলীয় প্রতীকে ইউপি ও পৌর নির্বাচন করার আইন পাশ করেছে। পৌরসভার সিংহভাগ নির্বাচন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। নির্বাচন কিভাবে সম্পন্ন হয়েছে তার মূল্যায়ন জনগণ ভালভাবে করছে!
প্রথম দফায় ইউপি নির্বাচন শুরু হচ্ছে ২২ মার্চ। আর ১০টি পৌর নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে ২০ মার্চ। প্রবাদ আছে, ‘সকালেই বুঝা যায় সারাদিন কেমন যাবে’ তারপরও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে প্রথম দফা ইউপি নির্বাচনে অনেক প্রার্থী মাঠে নেমেছে। দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে গিয়ে আ’লীগ ও বিএনপি’র ঘাম ঝরছে। দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে গিয়ে বেশিরভাগ এলাকায় মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও বেশুমার। মনোনয়ন বঞ্চিতরা অভিযোগ করছে, সারা জীবন রাজনীতি করেছি, কিন্তু দল মূল্যায়ন করেনি। আবার অনেকেই বলছে, ‘ওসব কি দরকার, দল করি টাকা কামাই, মনোনয়নও আমরা পাই।’ কোন কোন ক্ষেত্রে মনোনয়ন বঞ্চিতরা কলা গাছ নিয়ে প্রতিবাদ করছে। বিদ্রোহী প্রার্থীও হচ্ছে। গ্রামের প্রবীণদের অভিমত, পাথরে ধান রোপন করলে যেমন ফল পাওয়া যায় না আর রাস্তায় কলা গাছ রোপন করলেও মনোনয়ন পাওয়া যায় না। ‘যতই করুক শিব সাধনা, হিজড়ার কখনও সন্তান হবে না।’ আর যারা ভাগ্যবান, দলের প্রতীক বরাদ্দ পেয়েছে তাদের অভিমত, জনপ্রিয়তার কি দরকার, দলের প্রতীক পেলেই হয়। দলের প্রতীক যেন, তাদের কাছে হযরত সোলায়মান (আঃ) এর আংটি। বিশেষ করে নৌকা প্রতীকের জন্য আ’লীগের নেতাকর্মীরা যেন পাগল প্রায়, ধানের শীষের জন্য প্রার্থী থাকলেও তারা অনেকটা পা ভাঙ্গা মুরগীর মত শিয়ালের সামনে অসহায়। দলের পক্ষ থেকে তৃণমূলের বেশক’জনের নাম কেন্দ্রে পাঠালেও মনোনয়ন পাচ্ছে একজন। বঞ্চিতরা চরম হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে। সান্তনা দিতে পাচ্ছে না মনকে, বুঝাতে পারছে না ভোটার, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে। অতীতে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হত, সকলেই এ-ক্লাসের লোকজন। তাদেরকে পাবলিক সমীহ করত। তারা এলাকায় জনকল্যাণমূলক কাজ-কর্ম করতে ভুল করত না। সে সময়ও রাজনীতি ছিল। তবে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন কোনদিন কেউ দেখেনি। অতীতে যেসব ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতো, তাদের কথা যুগে যুগে মানুষ স্মরণ করছে। এখন যারা নির্বাচিত হবে তারা হবে নির্ধারিত দলের নেতাকর্মী। তারা কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা আছে, তা মূল্যায়ন করবে নির্বাচন শেষে। ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে একটি গ্রাম্য আদালতও চালু রয়েছে। সে আদালতও আর নিরপেক্ষ থাকবে না। গ্রাম্য আদালতও দলীয় করণের রাহুগ্রাসে চলে যাবে। ইউপি নির্বাচনের শুরুতেই নাকি অনেক ইউনিয়নে বিএনপি প্রার্থীরা মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারেনি। প্রথম দফা নির্বাচনে অর্ধশতাধিক চেয়ারম্যান গত সংসদ নির্বাচনের মত ভোটবিহীন নির্বাচিত হতে যাচ্ছে। ছোটবেলায় যখন খৎনার কথা শুনেছি, তখনি কান্নাকাটি করেছি। তারপরও খৎনা করেছে। খৎনা করতে গিয়ে কি কষ্ট পেয়েছি, তা এখনও স্মরণ আছে। আর যদি মায়ের পেট থেকে খৎনা করা শিশু জন্ম হয় (পয়গাম্বরী খৎনা) সে কিভাবে বুঝবে খৎনার যন্ত্রণা। বর্তমানে শাসকদলের প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে বলে বেড়াচ্ছে, দলের প্রতীক পেলে বিজয়ী হতে জনগণের ভোটের প্রয়োজন হবে না। এভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়ে পর্যন্ত দলীয়করণ করা হয়, নির্বাচনের প্রয়োজন কি? রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বাচনের আয়োজন করার কোন যৌক্তিকতা নেই। একজন নাগরিকের ভোটাধিকার যদি এভাবে কেড়ে নেয়া হয়, তাহলে পাবলিক ভোটের উপর আস্তা হারাবে। সাধারণ ভোটারেরা ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হবে না। এরশাদ জামানায় সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ডাঃ আবদুল মতিন সংসদে বলেছিলেন, ৫ হোন্ডা ১০ গুন্ডাই ভোট নিতে যথেষ্ট। তাদের পতনের পর একটি স্লোগান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, ‘আমার ভোট আমি দিব, যাকে ইচ্ছা তাকে দিব।’ এ স্লোগান কবর রচিত হয়েছে গত সংসদ নির্বাচনের পর। গ্রামের সাধারণ মানুষ দল বুঝে না। যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিতে চায়। ইতিমধ্যে এলাকায় একটি কথা সকলের মুখে শোনা যাচ্ছে, ‘দলের জন্য যত ত্যাগী-ই হোক, টাকা না থাকলে মনোনয়ন পাওয়া যাবে না।’ নির্বাচিত হওয়ার পর ওইসব জনপ্রতিনিধি ভোটের জন্য ব্যয় করা টাকা তার কাছ থেকে সংগ্রহ করবে তা নিয়ে মন্তব্যের প্রয়োজন নেই। যায় যদি যাক প্রাণ, হিরকের রাজা হবে ভগবান। এমন মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন হলে একদিন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আমজনতা আগামী ২০ ও ২২ মার্চের পৌর ও ইউপি নির্বাচন দেখার আশায় দিন কাটাচ্ছে। ভোট গ্রহণে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারা এখনই বলতে শুরু করেছে, আমাদের করার কি আছে? কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাইব। যারা সরকারি চাকুরী করে তাদের হাত-পা বাঁধা। কেছুর মত মেরুদন্ড নেই। যদি নড়াচড়া করতে না পারতাম, তাহলে উদ্ভিদ বললে সমস্যা হত না। আমরা প্রজাতন্ত্রের গোলাম। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারই ইচ্ছায় কাজ করি। সেদিন চায়ের দোকানে এক বেরসিক প্রবীণ ব্যক্তি হঠাৎ বলতে শোনা গেল, আজ থেকে ৫০ বছর আগেও মানুষ চা খেয়েছে, তখনও চায়ের কাপে ফুঁ দিত, এখনও ফুঁ দেয়, কিন্তু তখনকার ফুঁ আর এখনকার ফুঁ’র মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক। তখন চায়ের কাপে ফুঁ দিত দুধের সর সরানোর জন্য, এখন ফুঁ দেয়, পটের দুধের ফেনা সরানোর জন্য। সে সময়ের জনপ্রতিনিধি ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যবধানও অনুরূপ।
পাঠকের মতামত: