চকরিয়া নিউজ ডেস্ক ::
বিশ হাজার ফুট ওপর থেকে প্লেনের জানালার পাশে বসে যখন দৃষ্টি যাবে সমুদ্রের নীলাভজলে- তখন ভেসে উঠবে উপকূলে ছোট্ট একটি ঝিনুক। ধীরে ধীরে প্লেন যতই নিচে নামবে, ঝিনুকের আকৃতি ততই বড় হয়ে উঠবে।
সমুদ্রতীরের কাছাকাছি নেমে আসার পর নবাগত যাত্রীরা বুঝবে এটা ঝিনুক নয়, এটাই কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল। এমন দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিকতায় সাজানো হয়েছে এই নতুন টার্মিনাল ভবনের নক্সা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে স্বপ্নের এই টার্মিনাল।
গত বুধবার অর্থমন্ত্রী এই প্রকল্পের আর্থিক অনুমোদন দিয়ে ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদানের বিষয়টি ফয়সালা করেছেন। এখন আর দিন গোনা নয়, ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের প্রস্তুুতি চলছে।
সিভিল এভিয়েশানের নেয়া অন্যতম এই প্রকল্পের কাজ আগামী দেড় বছরে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান। বলেছেন, সত্যিই এটি দেখার মতো একটি টার্মিনাল।
পর্যটনের স্বর্গভূমি কক্সবাজারের নতুন মাত্রা যোগ করবে আন্তজার্তিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল। সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী জানিয়েছেন, এক লাখ বর্গফুটের কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক মানের প্যাসেঞ্জার ভবন নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণ করবে দুটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সিআরএফজি ও এনডিই।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক জানিয়েছেন, কক্সবাজার বিমানবন্দর দেশের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরসমূহের অন্যতম। বর্তমানে এ বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে দশটি যাত্রীবাহী ও চারটি কার্গো বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ করে।
দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের যাতায়াত সুবিধায় পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের মধ্যে সুপরিসর বিমান চলাচল সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক হয়ে গেছে।
এ লক্ষ্যে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় রানওয়ের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বর্ধিতকরণ, লাইটিং সিস্টেম ও যন্ত্রাপাতি স্থাপনসহ রানওয়ের সুবিধাদি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মানদন্ডে উন্নীত করা হচ্ছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের সঙ্গে সরাসরি বহির্বিশ্বের যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন নির্মাণ আবশ্যক। এ লক্ষ্যেই প্রকল্পটি ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বেবিচকের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, আগামী দেড় বছরের মধ্যে এ প্রকল্পটি শেষ হবে। তারপর তৃতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু হবে আরও সুবিস্তৃত। কারণ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার জন্য কিছু সময় লাগছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতোমধ্যে সেখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজও শুরু হয়ে গেছে।
প্রকল্প অনুমোদনের পরদিন সিভিল এভিয়েশন সদর দফতরে গিয়ে দেখা যায়-এটি বাস্তবায়নের ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান, সদস্য এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান ও প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দুু বিকাশ জরুরী বৈঠকে এ প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করেন।
তাদের ভাষ্যমতে, ঈদের পরই ঠিকাদারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যাদেশ ও সাইট বুঝিয়ে দেয়া হবে। তারা মাসখানেকের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য বস্তুসামগ্রীর স্তূপ গড়ে তুলবেন। তারপর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হবে।
চীনের একটি বিখ্যাত নির্মাণ কোম্পানি ও বাংলাদেশের শীর্ষ নির্মাতা কোম্পানি এনডিই যৌথভাবে এই প্রকল্পটির কাজ বেশ আস্থার সঙ্গেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান।
এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী জানিয়েছেন,আন্তজার্তিক মানের একটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যেই দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক ঝাঁক তরুণ প্রকৌশলীকে বাছাই করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালনার দায়ভার ন্যস্ত করা হয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুল হাসিবকে- যিনি ইতোমধ্যে কক্সবাজারের প্রকল্প-১ এর কাজে বেশ সুনাম ও দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন।
কী কী থাকছে এই প্রকল্পে জানতে চাইলে সুধেন্দু বলেন, কি নেই তাতে। এখানে এমন কিছু অতিরিক্ত সুবিধাদি থাকছে- যা দেশের অন্য কোন বিমানবন্দর- এমনকি হযরত শাহজালালেও নেই।
বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক অবয়বের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সমুদ্রের নীলাভ জলরাশির পাশেই বালুময় তীরে অনেক জীবাশ্ম থাকে। এদের অন্যতম ঝিনুক, যা নদীমাতৃক বাংলাদেশের আবহমানকালের চিরচেনা রূপ। এই ঝিনুকের আকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি করা হয়েছে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের নক্সা।
বর্তমান পুরনো টার্মিনালের উত্তর পাশেই এক লাখ বর্গফুটের ওপর এমনভাবে নক্সা প্রণয়ণ করা হয়েছে যা বিশ হাজার ওপর থেকে দেখলে মনে হবে সাগর তীরে একটা ঝিনুক পড়ে আছে। জানালার পাশে বসা প্লেনের যাত্রীরা যতোই নিচে নেমে আসবেন ততোই এই ঝিনুক রূপান্তরিত হবে টার্মিনাল ভবনে। প্লেন থেকে নামার পর যাত্রীদের ধোঁয়াশা দূর হবে। মুক্তোর মতো সাদা টার্মিনালের ছাদটাকে মনে হবে- প্লেনে বসে দেখলাম ঝিনুক, এখন দেখছি এয়ারপোর্ট।
প্রকল্প পরিচালক আমিনুল হাসিব জানান, বর্তমান টার্মিনাল ভবনে প্রবেশমুখের উত্তর দিকে থাকছে নতুন টার্মিনালের প্রবেশদ্বার। মূল টার্মিনালটি উত্তর দক্ষিণে সুবিস্তৃত এক লাখ বর্গফুটের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে থাকছে অত্যাধুনিক মানের বোর্ডিং ব্রিজ, যা টার্মিনালের মাঝ বরাবর সংযোগ দেবে।
আগমনী ও বহির্গমন যাত্রীদের জন্য আলাদা আলাদা এক্সেলেটর, হাই¯িপড লিফট, চারটি চেকইন কাউন্টার, একটি সুবিশাল হোল্ডিং লাউঞ্জ, ইমিগ্রেশন কাস্টমস কর্নার, ৫টি কনভয় বেল্ট, ডিজিটালাজাইড সিকিউরিটি সিস্টেম, এয়ার পার্কিং জোন, এপ্রোনসহ অন্যান্য সুবিধাদি।
আরও থাকছে- পাম্প হাউস, গার্ড রুম, ইন্টারনাল রোড, ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, গোটা বিমানন্দরের কভারেজ সুবিধার সিসিটিভি, হ্যাান্ড ব্যাগেজ ওয়াকিটকি, সর্বত্র অটো কানেক্ট ওয়াইফাই, পিএবিএক্স, টেপ রেকর্ডার ও বিশালাকৃতির মেটাল ক্লক।
ভিআইপি যাত্রীরা টার্মিনালে প্রবেশ করবেন পূর্বপাশ ও সাধারণ যাত্রীরা উত্তর দিকের গেট দিয়ে। এক সঙ্গে চারটি কাউন্টারে এক হাজার যাত্রীর সেবা মিলবে। এভাবে দিবারাত্রি চব্বিশ ঘণ্টায় কমপক্ষে ১০ হাজার যাত্রী সেবার সক্ষমতা থাকবে এখানে। আপাতত আন্তজার্তিক ও অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের আলাদা আলাদা কাউন্টারে হ্যান্ডলিং দেয়া হবে।
এ বিষয়ে এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কক্সবাজার আন্তজার্তিক বিমানবন্দরকে ধাপে ধাপে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক রূপ দেয়া হচ্ছে। এরই ধারবাহিকতায় প্রকল্পটিকে তিন ভাগে হাতে নেয়া হয়েছে। এর প্রথম পর্যায়ের কাজ প্রায় ৯ হাজার ফুট দৈর্ঘ্যরে রানওয়ে, এপ্রোচ, এপ্রোন ও লাইটিংয়ের কাজ প্রায় শেষ।
এখন শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিকমানের একটা প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল। এটা শেষের পর হাতে নেয়া হবে আরও সুবিস্তৃত সম্প্রসারণ কাজ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম হাব তৈরির বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই কক্সবাজার এয়ারপোর্টে সব অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
একটি সূত্র জানায়, কোন ধরনের কালক্ষেপণ না করে ঠিক দেড় বছর পর প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের কাজ শেষ করার লক্ষ্য মাত্রা নিয়েই প্রকৌশল বিভাগকে আন্তরিক ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান।
তিনি জানালেন, এই টার্মিনাল দিয়ে আপাতত ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যাত্রীসেবা দেয়া যাবে। তারপরের বাস্তবতায় একটি সুপরিসর টার্মিনাল ভবন নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে। যতো দ্রুত জমি অধিগ্রহণের জটিলতা নিরসন হবে- ততোই সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে।
সিভিল এভিয়েশন জানিয়েছে, কক্সবাজার এয়ারপোর্টের বর্তমান পুরনো টার্মিনালটি আপাতত অভ্যন্তরীণ হিসেবেই ব্যবহার হবে।
তৃতীয় পর্যায়ের মূল টার্মিনাল তৈরির পর বর্তমান ভবনটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে।
এ সম্পর্কে সচিব মুহিবুল হক বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবেই গড়ে তোলা হবে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেঁষে রাতের আলোতে ফ্লাইট ওঠানামার সময় অভূতপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করবেন যাত্রীরা। কারণ সমুদ্রের মাঝে স্থাপন করা এপ্রোচ লাইটিংয়ে অনন্য রূপ পাবে নীলাভ জলরাশি।
পাঠকের মতামত: