ঢাকা,মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪

বন্যার তাণ্ডব থেকে  রক্ষা পাবে ১৫ হাজার মানুষ

চকরিয়ায় শতবছরের দুটি ভরাট খাল খনন: ভাগ্য পরিবর্তনে হাজারো কৃষক

এম জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের শতবছরের পুরানো উমখালী খাল ও পুরাতন মাতামুহুরী শাখা খাল খননে ভাগ্য বদলের নতুন স্বপ্ন দেখছেন এলাকার হাজারো কৃষক। তিনমাস আগেও দুটি খাল পলি মাটি জমে ভরাট থাকায় পানি সুবিধা অনিশ্চয়তায় চাষাবাদ নিয়ে চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠায় ছিলেন স্থানীয় কৃষকেরা। খালগুলো পলি জমে নাব্যতা হারানোর কারণে পানি সংকটে পড়ে নিরবিচ্ছিন্ন চাষাবাদ নিয়ে কৃষকদের এমন দুর্ভোগ দৈন্যদশা ছিল বেশ কয়েকবছর ধরে।

এলাকার কৃষকদের জিইয়ে থাকা দুর্ভোগ দুর্দশার বিষয়টি আমলে নিয়ে স্থানীয় চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল হোছাইন চৌধুরী ইতোপূর্বে চকরিয়া উপজেলা পরিষদের মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় একাধিকবার আবেদন জানিয়েছেন ভরাট শাখা খালগুলোর নাব্যতা উদ্ধারে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে সদ্য সাবেক চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) জেপি দেওয়ান এর সরেজমিন পরিদর্শনে বিষয়টি গুরুত্ব আরও বেগবান হয়ে উঠে। এরপর চিরিঙ্গা ইউনিয়নের শতবছরের পুরানো উমখালী খাল ও পুরাতন মাতামুহুরী শাখাখাল দুটি খননে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় স্থানীয় এমপি জাফর আলমের ডিও লেটারে কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের সুপারিশক্রমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়।

চকরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর সুত্রে জানা গেছে, উপজেলা প্রশাসনের চাহিদাপত্রের বিপরীতে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের শতবছরের পুরানো উমখালী খাল ও পুরাতন মাতামুহুরী শাখা খালের সাড়ে তিন কিলোমিটার অংশ খননে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কতৃক চলতি ২০২৩-২০২৪অর্থবছরে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় কাবিখা ও কাবিটা কর্মসুচির আওতায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন।

প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় কতৃক অর্থবরাদ্দ নিশ্চিত হয়ে গতবছরের অক্টোবর মাসে চিরিঙ্গা ইউনিয়নে শতবছরের ভরাট উমখালী খাল ও পুরাতন মাতামুহুরী শাখা খাল খনন আনুষ্ঠানিক শুরু করা হয়। গেল ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের মাঠপর্যায়ে কর্মরত প্রকৌশলীদের নিবিড় তদারকির মাধ্যমে সুচারুভাবে সাড়ে তিন কিলোমিটার খাল খনন কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে।

চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্পের আওতায় চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের সার্বিক সহযোগিতায় চিরিঙ্গা ইউনিয়নের হাজারো কৃষকের দু:খ খ্যাত উমখালী খাল ও পুরাতন মাতামুহুরী শাখা খাল অবশেষে খনন করা সম্ভব হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী চিরিঙ্গা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সীমানা লাগোয়া একসময়ের প্রবহমান খালের সাড়ে ৩ কিলোমিটার ভরাট অংশ বিশেষ করে পুর্ব সওদাগরঘোনা নুরুল কবিরের বাড়ি থেকে স্লুইসগেট পর্যন্ত। সেখান থেকে আবদুল জলিলের বাড়ি হয়ে ব্রীজ সংলগ্ন কামাল উদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। এরপর আবদুল জলিলের বাড়ি হয়ে নুরুল আমিনের বাড়ি পর্যন্ত। সেখান থেকে মধ্যম সওদাগরঘোনা মোজাহের আহমদ এর বাড়ি হয়ে রাবার ড্যামের পশ্চিমে বাবু মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত মোট সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকায় খাল খনন কাজ সুচারুভাবে সমাপ্ত করা হয়েছে।

ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, সাড়ে ৩ কিলোমিটার খাল খনন ছাড়াও একই প্রকল্পের আওতায় চিরিঙ্গা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম সওদাগরঘোনা আবছারের বাড়ি থেকে বাটামনি স্লুইসগেট পর্যন্ত ও মোজাহের আহমদ এর বাড়ি থেকে বশির আহমদ এর বাড়ি পর্যন্ত দুটি গ্রামীণ বড়পরিসরে সড়ক সংস্কার কাজ করা হয়েছে।

দুটি ভরাট খাল খননে সুফল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে পলি মাটি জমে উমখালী খাল ও পুরাতন মাতামুহুরী শাখা খাল চরম নাব্যতা সংকটে ছিল। এই অবস্থার কারণে খালগুলোতে পানি প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে করে স্থানীয় কৃষকেরা প্রতিবছর চাষাবাদ করতে গিয়ে সেচ সুবিধার অভাবে নিদারুণ দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছেন। এথন খাল দুটি খননের ফলে পানি সংকটে দুর্ভোগ দুর্দশা কেটে গেছে। পাশাপাশি খাল দুটি ভরাট হয়ে পড়ার কারণে প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যার সময় বৃষ্টি আর ঢলের পানি সহজে লোকালয় থেকে নামতে পারতো না। তাতে করে পুরো চিরিঙ্গা ইউনিয়নের মানুষকে দীর্ঘ দিন পানিবন্দি অবস্থায় কাটাতে হতো।

তিনি বলেন, দীর্ঘ বছর পর সাবেক এমপি জাফর আলম ও কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা এবং চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে ভরাট দুটি খাল খনন কাজ করতে পেরে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ডের অন্তত ১৫ হাজার মানুষ আগামীতে বন্যার দুর্যোগ দুর্ভোগ থেকে স্থায়ীভাবে পরিত্রাণ পাবে বলে আমরা আশাবাদী। পাশাপাশি দুইটি খালে পানি চলাচল নিশ্চিত হওয়ায় স্থানীয় কৃষকেরা অনায়াসে চাষাবাদের সুযোগ পাবে। এতে চাষের জমির পরিধিও বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সরেজমিনে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম সওদাগরঘোনা বটতলী এলাকার কৃষক ওমর আলী (৬৫), ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম পাড়া এলাকার কৃষক কামাল হোসেন (৫৮), আব্বাস আহমদ (৬০) ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক শামসুল আলম (৪৮), মোহাম্মদ নবী (৪৫) ও নজির আহমদ (৫০) বলেন, বিগত কয়েকবছর ধরে আমরা চাষাবাদ নিয়ে সীমাহীন দুঃখে ছিলাম। বিশেষ করে শুস্ক মৌসুমে খালগুলো ভরাট হয়ে পড়ার কারণে পানি পাওয়া যেতনা। এই অবস্থায় চাষাবাদ না করে জমি খালী রেখে দিত হতো। আবার বিকল্প উপায়ে চাষাবাদ করতে গেলে স্কীম মালিককে দুই থেকে তিনগুণ টাকা বাড়তি দিতে হতো।

তাঁরা দাবি করেন, এইবছর ভরাট দুটি খাল খননের ফলে চাষাবাদের পানি সংকট নিয়ে আমাদের দু:চিন্তা কেটে গেছে। এখন আমরা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে খাল থেকে পানি নিয়ে চাষাবাদ করতে পারবো। দীর্ঘদিন পর হলেও আমাদের এলাকার শতবছরের ভরাট দুইটি খাল খননে ব্যবস্থা নেয়ায় কৃষিবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এবং এলাকার চেয়ারম্যান জামাল হোছাইন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাই।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ এসএম নাছিম হোসেন চিরিঙ্গা ইউনিয়নের দুটি ভরাট খাল খননে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের সবাইকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, একমাস আগে আমি চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পুর্ব সওদাগরঘোনা ও রাবার ড্যাম এলাকার চাষাবাদ পরিদর্শন করতে যাই। সেসময় দেখলাম পলি জমে ভরাট হয়ে পড়া খাল খননে কাজ চলছে। এটি নিসন্দেহে কৃষিখাতের জন্য একটি ভালো উদোগ।

তিনি বলেন, চিরিঙ্গা ইউনিয়নে চলতি মৌসুমে আমরা বোরো ধান আবাদে এবছর ২২০০ একর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। খাল দুটি খননের ফলে আরও দুইশত একর চাষের জমি বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবছর চিরিঙ্গা ইউনিয়নে ৭৫০ একর জমিতে সবজি চাষাবাদ করা হচ্ছে। খাল খননের ফলে এবছর আরও একশত একর জমিতে সবজি চাষ বাড়তে পারে। আশাকরি সেচ সুবিধার অভাব কেটে গেলে আগামীতে আরও চাষাবাদ বেড়ে যাবে চিরিঙ্গা ইউনিয়নে।

চকরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আবু হাসনাত সরকার বলেন, প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ অনুমোদনের আগে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিন পরিদর্শন করে খাল খননের সম্ভাব্যতা যাছাই করেন। এসময় তিনি এলাকার কৃষক ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে গণশুনানিও করেন। এরপর খাল খননের প্রয়োজনীতা নিশ্চিত হয়ে তিনি বিষয়টি তিনি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে পরিপত্রের মাধ্যমে অবহিত করেন। এরপর মন্ত্রণালয় কতৃক খাল খননের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের সার্বক্ষনিক তদারকির মাধ্যমে গত অক্টোবর মাসে শুরু হয়ে ডিসেম্বরের শেষ দিকে সমাপ্ত হয়েছে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের উমখালী খাল ও পুরাতন মাতামুহুরী শাখাখাল খনন কাজ। সাড়ে তিন কিলোমিটার ভরাট খাল খননের পাশাপাশি দুটি সড়ক সংস্কারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিশেষ বরাদ্দের আওতায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর এক কোটি ৪০ লাখ টাকার বাজেট দিয়েছেন। ইতোমধ্যে বরাদ্দের বিপরীতে টেকসই ও স্থায়ীভাবে খাল খনন ও সড়ক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.ফখরুল ইসলাম বলেন, গতমাসে এই উপজেলায় যোগদানের পর সবেমাত্র কয়েকটি ইউনিয়ন পরিদর্শন করে এলজিইডি এবং পিআইও দপ্তরের সঙ্গে
উন্নয়ন কাজসমুহ দেখেছি। বিশেষ করে খাল খনন কাজগুলো টেকসই ও দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। আমি মনে করি, ভরাট খাল খননে একদিকে কৃষকদের চাষাবাদের সেচ সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে বন্যার দুর্যোগ থেকে নিস্তার পাবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের জনসাধারণ।

পাঠকের মতামত: