ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় প্রতিবন্ধী মনছুর ও কিছু স্বপ্নবাজ তরুণের গল্প

monsurনিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::::

শারীরিক প্রতিবন্ধী মনছুর আলম (৪০)। কয়েকবছর আগে হঠাৎ দুই পা বেঁকে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। এর পরও প্রতিদিন ৫০ টাকা ভাড়ায় রিক্সা চালিয়ে সংসারের ভরণপোষণ চালাচ্ছিলেন মনছুর। বাড়িতে থাকা বাক প্রতিবন্ধী স্ত্রী গুলতাহার বেগম ও দুই মেয়েকে কোনমতে দুই বেলা ভাত দেয়ার পাশাপাশি বড় মেয়ে জান্নাতুল মাওয়াকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াচ্ছেন। কিন্তু অর্থাভাবে ছোট মেয়ে তছলিমা জন্নাতের পড়ালেখা একেবারেই বন্ধ ছিল। এই অবস্থায় কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ ঘুনিয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী মনছুরের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘একটি পরিবর্তনকামী মন পুরো দেশকেই বদলে দিতে পারে’ গানধারী ‘ইয়ং চেঞ্জ মেকার’ নামের স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন। মনছুরকে একটি রিক্সা কিনে দেয়া ছাড়াও তার ছোট মেয়ের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছে সংগঠনটি। যা রীতিমতো অনুপ্রাণিত করেছে অনেককে।

সংগঠনের সদস্যরা জানান, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছেদারিদ্র্য বিমোচন ও শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক অবস্থান বিবেচনায় সমাজ তথা দেশের সার্বিক কল্যাণে কাজ করা। এই মানসিকতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। এই সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের ‘স্বপ্নবাজ’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সংগঠনটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৮ জন এবং তাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। এদের অনেকে কলেজবিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যয়নরত। স্থানীয়দের কেউ কেউ তাদের ‘স্বপ্নবাজ১৮’ নামেই ডাকেন।

সম্প্রতি চকরিয়া পৌরশহর চিরিঙ্গার প্রোক্যাডেট কলেজ প্রাঙ্গণে সংগঠনটির প্রথম বর্ষপূর্তি, রিক্সা ও শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উপজেলা এনজিও সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নোমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী রনি সাহা। বিশেষ অতিথি ছিলেনসংগঠনের উপদেষ্টা চকরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পদ্মলোচন বড়ুয়া, অ্যাডভোকেট লুৎফুল কবির ও অ্যাডভোকেট ফাহাদ বিন ফিরোজ সোহান। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম খলিল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বাধীন মঞ্চের স্থায়ী পরিষদ সদস্য ব্যাংকার দেলোয়ার হোসেন, চকরিয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছোটন কান্তি নাথ, পিস ফাইন্ডারের প্রতিষ্ঠাতা আদনান রামীম, স্বাধীন মঞ্চের সমন্বয়ক আবুল মাছরুর আহমাদী ও রায়হানুল কবির প্রমুখ। অন্যান্যের মধ্যে ‘ইয়ং চেঞ্জ মেকারের’ প্রধান সমন্বয়ক শাহরুখ উল হোছাইন, সদস্য ছোঁয়া তাবাস্‌সুম, তাসমিনা জান্নাত চোহা, শান্ত চৌধুরী, প্রাণকমল বড়ুয়া জয়, তমা, শৈলী, মোর্শেদ, শিহার, এ্যালি, মুমু, রাশেদুজ্জামান রণ, চন্দন, সানিয়া, নাওমি, আসিফ, কুসুম ও মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ইয়ং চেঞ্জ মেকারের অন্যতম উদ্যোক্তা ও মুখপাত্র আততিহারুল কবির তিহার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ বেকার রয়েছেন। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম একজন ব্যক্তিকে উপার্জনের একটি ব্যবস্থা করে দেয়া। তাই প্রথমবারের মতো আমরা বেঁছে নিয়েছি শারীরিক প্রতিবন্ধী মনছুর আলমকে। স্বপ্নবাজদের মাসিক ১০০ টাকা চাঁদা থেকে জমানো টাকা দিয়ে প্রথমবারের মতো ১৭ হাজার টাকায় একটি প্যাডেল চালিত রিক্সা কিনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবন্ধী মনছুরকে হস্তান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি তার ছোট মেয়ের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার যাবতীয় খরচ বহন করা হবে। আর ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়েছে একটি মোবাইলও।’

তিহার বলেন, ‘তবে এই রিক্সা দেয়ার বিপরীতে মনছুরের সঙ্গে শর্তযুক্ত চুক্তি হয়েছে। প্রতিদিন ৫০ টাকা করে সংগঠনের কাছে ফেরত দিতে হবে তাকে। বছরের ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত এই টাকা ফেরত দেয়ার পর ওই রিক্সার পুরোপুরি মালিক হতে পারবেন মনছুর। এজন্য ৩০০ টাকা ননজুডিসিয়াল স্টাম্পে সংগঠনের পক্ষে নায়েবুল ইসলাম তুষার (প্রধান সংগঠক) ও উপকারভোগী মনছুরের মধ্যে একটি চুক্তিপত্রও সম্পাদন করা হয়েছে। এর পর সংগঠনের সদস্য হিসেবে প্রতিবন্ধী মনছুরও অন্তর্ভুক্ত হয়ে পরবর্তীতে অন্য কাউকে একইভাবে সহায়তায় সংযুক্ত থাকবেন। যা একটি ভালো উদ্যোগ বলে আমরা মনে করি।’

উপকারভোগী প্রতিবন্ধী মনছুর আলম এই সহায়তা পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নিজে প্রতিবন্ধী মানুষ, এই অবস্থায় বাক প্রতিবন্ধী স্ত্রী ও দুই কন্যার দুই বেলা ভাত যোগাড় করা আমার পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। সেখানে একটাকা ছাড়া একটি রিক্সা এবং ছোট মেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়ায় আমাকে চিরঋণী করেছে ছোট ছোট ছেলেদের এই সংগঠন। দোয়া করি তারা যেই উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগঠনে শামিল হয়েছে তাদের সেই উদ্দেশ্য যাতে পূরণ হয়।’

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উপজেলা প্রকৌশলী রনি সাহা বলেন, ‘যে কোন আন্দোলন, সংগ্রাম, সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণ, সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে যুগে যুগে যুবকতরুণেরাই এগিয়ে এসেছে। আশা করি এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছেলেরা পারবে সমাজকে বদলে দিতে। তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা করে একবছর পার করার পর বর্ষপূর্তিতে একজন প্রতিবন্ধী পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে তা নজিরবিহীন।’

সংগঠনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট লুৎফুল কবির বলেন, ‘তোমরা যারা এই সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মানবতার সেবা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছ, তা ভবিষ্যতে পাথেয় হয়ে থাকবে। তোমাদের মনে রাখতে হবে, বয়সে একদিনের বড় হলেও তাকে সম্মান করতে দ্বিধা করবে না। এতেই তোমরা সফল হবে। তবে পড়ালেখার পাশাপাশি এই কাজ চালাতে হবে তোমাদের। ভবিষ্যতে যাতে তোমাদের আক্ষেপ করতে না হয় এই বলে যে, ‘ভাল কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করে ফেললাম।’পিস ফাইন্ডারের প্রতিষ্ঠাতা আদনান রামীম বলেন, ‘মাত্র ষোলসতের বছরের ছেলেগুলো দেশ আর সমাজটাকে নিয়ে ভাবে, ভাবে দেশের অর্থনীতি, সম্প্রীতি, সামাজিক ও আর্থিক ভারসাম্য নিয়ে। ছেলেগুলোর চিন্তাচেতনা অসাধারণ, অবাক করার মতো। তাদের রয়েছে অদম্য দেশপ্রেম। আমরাও তাদের পাশে থাকব সবসময়। এতে এগিয়ে যাবে দেশ, এগিয়ে যাবে দেশের মানুষ।

রামিম বলেন, ‘ভাবতে পারেন, আগামী ২০৩০ বছর পর যখন এই ছেলেগুলো দেশটাকে নেতৃত্ব দেবে, তখন এরাই হবে সমাজের ও দেশের একজন। তখন আমাদের দেশটা কোন উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছাবে।

 

পাঠকের মতামত: