ঢাকা,বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০২৪

কক্সবাজারের দ্বীপ ছাড়ছে ওরা

ছবির ক্যাপশন ::: কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে সাগরের সঙ্গে জোয়ার-ভাটায় একাকার।

Islandকক্সবাজার প্রতিনিধি ::

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপের একাংশ প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। দ্বীপের ৪০ হাজার মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রায় এক হাজার বাসিন্দা বসতবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এর কারণ, দ্বীপের চারপাশে পাঁচ বছর আগে যে বাঁধ ছিল, তা ভেঙে গেছে। নতুন করে তা আর নির্মাণ করা হয়নি।

 স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ এলাকার নাম শাহপরীর দ্বীপ। দ্বীপের পূর্ব পাশে নাফ নদ। নদের উত্তর পাড়ে মিয়ানমার। পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে বঙ্গোপসাগর। স্বাধীনতার আগে দ্বীপের দৈর্ঘ্য ছিল ১৫ কিলোমিটার ও প্রস্থ ছিল ১০ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ছোট হয়ে দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটার ও প্রস্থ দুই কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। এটি বঙ্গোপসাগর হয়ে নাফ নদ থেকে প্রবাহিত বড় খাল দিয়ে বিচ্ছিন্ন জনপদ। আগে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সেতু দ্বারা সংযুক্ত ছিল। বিগত ২০১২ সালের জুনে দ্বীপটির পশ্চিমাংশে ভাঙনের পাশাপাশি প্রবল স্রোতে বড় খালের সেতু উপড়ে যায়। ভেঙে যায় সংযোগ সড়ক। সাগরের তোড়ে দ্বীপটির পশ্চিমপাড়া, মাঝেরপাড়া, ডাংগরপাড়া, জাইল্লাপোতা, গোলাপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার বেশির ভাগ অংশ ভেঙে গেছে। বসতিহারারা টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারের পাহাড়ি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ সামর্থ্য অনুযায়ী টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে জমি কিনে বসতবাড়ি বানিয়েছে।

কথিত আছে, সুবেদার শাহ সুজা তাঁর স্ত্রী পরীবানুকে নিয়ে আরাকানে পালিয়ে যাওয়ার সময় এ এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন। এরপর শাহ সুজার ‘শাহ’ ও পরীবানুর ‘পরী’ মিলিয়ে নামকরণ হয় ‘শাহপরীর দ্বীপ’।

শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা সোলতান আহমদ বলেন, ‘ছোট্টকালে দেখেছি, রাতে যেখানে-সেখানে আলো জ্বলত। সবাই মনে করত, জিন বা পরি। আমরা ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করতাম। রাতের বেলায় আগুন নিয়ে চলাফেরা করতেন বাপ-দাদারা। এখন কিন্তু সেই আলো আর জ্বলে না। ’

শাহপরীর দ্বীপ উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এম এ হাসেম বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে দ্বীপের পশ্চিম অংশে বেড়িবাঁধের সামান্য অংশ সাগরের ঢেউয়ে ভেঙে যায়। ওই ছোট্ট অংশ সংস্কার না করায় এখন দ্বীপটি মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন দ্বীপটিতে বেড়িবাঁধের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। জোয়ার মানেই পানি আর পানি। ১৩টি গ্রামের দ্বীপে ১০টি টিকে আছে। বর্ষাকালে সবাই আতঙ্কে থাকে। ’

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাহেদ হোসেন বলেন, ‘লবণ, চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের জন্য বিখ্যাত এলাকা এই দ্বীপ। এখন এ দ্বীপে কোনো চিংড়ির ঘের নেই। লবণের মাঠগুলোও সমুদ্র। ’

হাজীপাড়ার চিংড়ি চাষি আসাদ উল্লাহ বলেন, ‘কয়েক একর জমিতে শখ করে মাছের ঘের তৈরি করেছিলাম। কয়েক লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু সমুদ্রের ভাঙনে ঘেরও গেল, জমিও গেল। এখন এলাকা ছেড়ে শহরে গিয়ে অন্য কাজ করছি। ’ টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান বলেন, ‘যে সড়কটি রয়েছে, সেটি যদি কয়েক ফুট উঁচু করে সংস্কার করা হতো তবে ভোগান্তি কমত। এখন জোয়ারের সময় ছোট্ট বোট ও ডিঙি নৌকায় টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। আর ভাটা মানে তিন কিলোমিটার কাদা ও জরাজীর্ণ সড়কে পায়ে হাঁটার ভোগান্তি। ’

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, ‘একনেকে ১০৬ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়েছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। ’ কাজে স্বচ্ছতা চায় এলাকাবাসী

এদিকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। গত ১৩ জানুয়ারি বিকেল ৩টা হতে ৪টা পর্যন্ত মানববন্ধন করে কয়েক হাজার বাসিন্দা। এ মানববন্ধনে প্রকল্প পাস করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বক্তারা বলেন, ‘২০১১ সালের পর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও দ্বীপটি রক্ষা করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, যথাসময়ে কাজ শুরু না করা এবং দুর্নীতি করা। এবার বড় প্রকল্প। এটাতে যদি দুর্নীতি হয়, তাহলে আর দ্বীপটি রক্ষা করা যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সেনা বা নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধান ছাড়া টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। ’

শাহপরীর দ্বীপ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সোনা আলী বলেন, ‘সরকার যে বরাদ্দ দিয়েছে, তা নিয়ে এলাকাবাসী খুশি। ’

ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ, তিনি দ্বীপের বেড়িবাঁধ আরো বর্ধিত কলেবরে একনেকে পাস করিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে বাঁধ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। এবার যাতে সে ধরনের কিছু না হয় সে ব্যাপারে এর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ’

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে। এ জন্য দরকার মন্ত্রণালয়ের কিছু দাপ্তরিক কাজ। এসব সম্পন্ন না হওয়ায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বাঁধ দিয়ে পানি ঠেকানো। সেটা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি দরকার। ’

কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া বলেন, ‘টাকা পড়ে রয়েছে। কিন্তু দ্বীপ রক্ষা বাঁধ না হওয়ায় এর দরপত্র দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আলী হোসেন বলেন, ‘দ্বীপের পাশে সাবরাং ইউনিয়নে এক হাজার একরেরও অধিক জমিজুড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। আসন্ন বর্ষার আগেই যেকোনোভাবে দ্বীপের বেড়িবাঁধ নির্মাণের পদক্ষেপ দ্রুত নেওয়ার চেষ্টা করছি। সেই সঙ্গে বেড়িবাঁধের পাশে সবুজ গাছ লাগানো হবে। ’

পাঠকের মতামত: