ঢাকা,শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার কস্তুরাঘাটে বাঁকখালী নদীর ভরাট অংশে প্রশাসনের নিষেধ সত্বেও চলছে প্যারাবন উজাড় করে দখলবাজী উৎসব

বিশেষ সংবাদদাতা, কক্সবাজার :: কক্সবাজার শহরের প্রাণ বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায় প্যারাবন কেটে অবৈধভাবে নদীর জমি দখলের ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের
শীর্ষ নেতাকে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে বারণ করেছেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি শেখ মনিরুল গিয়াস। দীর্ঘ বাঁকখালী নদীর অববাহিকায় বৃটিশ রাজের পক্ষে কেপ্টেন হিরাম কক্স গড়ে তুলেছিলেন ইতিহাসের কক্সবাজার শহর। এই বাঁকখালী নদী এখন পর্যটন শহর কক্সবাজার এর প্রাণ বলেই খ্যাত। কালের স্রোতে ক্রমে ভরাট হয়ে যায় নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় সবুজ বনায়ন করে পরিবেশ বান্ধব করা হলেও সেখানে নজর পরে একটি ভূমি দস্যু চক্রের। সম্প্রতি ওই ভূমি দস্যু চক্রটি অস্ত্রের মহড়া দিয়ে সেখানে সৃজিত প্যারাবন সাবাড় করে প্লট করে জমি বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
অভিযোগের ভিত্তিতে দেরীতে হলেও প্রশাসন অভিযান চালিয়েছে সেখানে। কিন্তু বারণ করতে পারেনি ওই শক্তিশালী চক্রকে। এপ্রসঙ্গে সদর মডেল থানার ওসি মুনিরুল গিয়াস বলেন, শনিবার সকাল থেকে জমি দখলের ঘটনা নিয়ে কয়েকবার ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দখলবাজি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু যতক্ষণ পুলিশ থাকেন ততক্ষন দখলবাজি বন্ধ থাকে। পুলিশ ঘটনাস্থল ত্যাগ করলেই পুণরায় দখল কার্যক্রম শুরু হয়। দখলবাজিকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। যে কোন মূল্যে এই দলবাজি বন্ধ করার দাবী জানিয়েছেন কক্সবাজার এর সচেতন মহল। তবে প্রশাসনের পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কোন কাজ চলবেনা বলে জানা গেছে। ওই নির্দেশ না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।
এদিকে শনিবার প্রশাসনের অভিযান এবং দখলবাজি বন্ধ রাখার নির্দেশ সত্তেও রাতে আবারো দখল কার্যক্রম অব্যাত রাখলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৪ জন শ্রমিককে আটক করে।
সরে জমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাটস্থ ঐতিহ্যবাহি বাঁকখালী নদীর প্যারাবন, নিধন করে দখলের মহোৎসব চলাচ্ছে একটি প্রভাবশালী ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট প্যারাবন কেটে ও পাহাড়ি মাটি ফেলে ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে সেখানে। পাশাপাশি শতাধিক শ্রমিক দিয়ে জমি ভরাট করে তা চড়াদামে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। সম্প্রতি বাঁকখালী থেকে বালু উত্তোলনের ডাক নেওয়ার নামে প্যারাবন ভরাট করে দখল করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। আর ওই সিন্ডিকেটই মূলত দখল প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
দেখা গেছে, দখলের ধারাবাহিকতায় ১১ জুন শনিবার সকালে শতাধিক পুরুষ ও নারী নিয়ে জমি দখলে নিতে যায় কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের একজন অন্যতম শীর্ষ নেতার নেতৃত্বে ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। কয়েক দফায় পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েও দখল কার্যক্রম বন্ধ করতে না পারায় এক পর্যায়ে বিকেল ৪টার দিকে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া, সহকারি কমিশনার (ভূমি) জিল্লুর রহমান, কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি শেখ মনীরুল গীয়াসসহ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা ও অর্ধ-শতাধিক পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এসময় কর্মকর্তারা দখলবাজদের দখলবাজি বন্ধে কঠোর হুশিয়ারি প্রদান করেন। পাশাপাশি জমি পরিমাপ ও যাচাই বাছাই করে সরকারি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য সার্ভেয়ারকে নির্দেশ প্রদান করেন।
কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) জিল্লুর রহমান বলেন, ১১ জুন শনিবার সকাল থেকে প্যারাবন কেটে জমি দখলের ঘটনা নিয়ে নানাভাবে অভিযোগ আসে। এক পর্যায়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। এসময় দখলবাজদের দখলবাজি বন্ধে কঠোর হুশিয়ারি প্রদান করা হয়। পাশাপাশি জমি পরিমাপ ও যাচাই বাছাই করে সরকারি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য সার্ভেয়ারকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। তিনি আরো বলেন, প্যারাবন কেটে জমি দখলের ঘটনা নিয়ে পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি দেখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, সিএস জরপি অনুযায়ি বাঁকখালী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় প্রতিনিয়ত অবৈধ দখলবাজদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
উল্লেখ্য ১৯৯১-৯৫ সালেও ওই এলাকায় ছিল প্রমত্তা বাঁকখালী নদীর জোয়ার ভাটা। এখান থেকে চলাচল করত কক্সবাজার-মহেশখালী-কুতুবদিয়া ও চট্টগ্রামের সাগর পথে বড় বড় স্টিমার, লঞ্চ, যাত্রীবাহী ও মালামাল বোঝাই বোট। এই প্রতিবেদক নিজেও ওই স্থান থেকে মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও চট্টগ্রাম যাতায়াত করেছে বহুবার। এখানেই দীর্ঘদিন চাপা পড়ে আছে বিআইডব্লিউটিএর একটি টার্মিনাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা।
প্রায় এক যুগ আগে জাপানী সংস্থা জাইকার সহযোগিতায় নদী ভরাট ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় পরিবেশ সাংবাদিক সংগঠনের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় ব্যাপক সবুজ বনায়ন। কিন্তু ভূমি দস্যু সিন্ডিকেট ওই সবুজ বনায়ন ধংস করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। পাশাপাশি এতে ধংস হচ্ছে পরিবেশ ও সৌন্দর্য।

পাঠকের মতামত: