ঢাকা,বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহন শাখার আলোচিত ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলা তদন্তে দুদক

রামু প্রতিনিধি ::
কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহন শাখায় রেল লাইনের ভূমি অধিগ্রহনের ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর বহুল আলোচিত মামলাটি র্দীর্ঘদিন পর তদন্তে নেমেছে দূর্নীতি দমন কমিশন কক্সবাজার। মামলার বাদী ও বিবাদীদের সম্প্রতি নোটিশ দিয়ে তদন্তকার্য শুরু করেছেন- দূর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয় কক্সবাজারের উপ সহকারি পরিচালক তাপছির বিল্লাহ।

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া গ্রামের আবুল কালাম গং বাদী হয়ে ২০২০ সালে কক্সবাজারের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফছার, ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা মর্তুজা আল মুঈদ ও আবুল হাসনাত, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা দেবতোষ চক্রবর্তী, ভূমি অধিগ্রহন শাখার নেপাল চন্দ্র ধর, সার্ভেয়ার মাসুদ রানা, চিহ্নিত দালাল শাহজাহানসহ ১৮ জনকে আসামী করে কক্সবাজার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে ভূমি অধিগ্রহনের ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা (নং ২০/২০২০) দায়ের করেন।

বিজ্ঞ আদালত মামলাটি পরবর্তী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য দুদক চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেন। দূর্নীতি দমন কমিশন ‘দুদুক’ মামলাটি গ্রহণ করে তদন্তকারি কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়কে আদেশ দিলে সহকারি পরিচালক রিয়াজ উদ্দিনকে তদন্তকারি কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। উক্ত তদন্তকারি কর্মকর্তা তাঁর কার্যালয়ে মামলার বাদী, স্বাক্ষীগণের নিকট থেকে স্বাক্ষ্য গ্রহন করেন এবং স্বাক্ষীরা ঘটনার হুবহু সত্যতা প্রমাণে সক্ষম হন। এরইমধ্যে কক্সবাজারে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম কক্সবাজার কেন্দ্রিক হওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও দীর্ঘদিন মামলাটির কার্যক্রম অদৃশ্য কারণে থেমে যায়। এ কারণে মামলার বাদী ও স্বাক্ষীদের মাঝে ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও হতাশা দেখা দেয়। সম্প্রতি এ নিয়ে বাদী পক্ষের মৌখিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে কক্সবাজারে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মামলাটি তদন্তের জন্য উপ সহকারি পরিচালক তাপছির বিল্লাহকে দায়িত্ব দেন। এরই প্রেক্ষিতে ১২ সেপ্টেম্বর তিনি মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন। এরপরও এলাকার কৌতুহলী সচেতন জনগণের প্রশ্ন আদৌ আলোচিত এ মামলাটি আলোর মুখ দেখবে কিনা?

ভূমি অধিগ্রহনের ২ কোটি আত্মসাতের আলোচিত এ মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দূর্নীতি দমন কমিশন, কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ সহকারি পরিচালক তাপছির বিল্লাহ জানিয়েছেন- ইতিমেধ্য মামলার বাদি ও বিবাদী পক্ষকে নোটিশ পাঠিয়েছেন এবং স্বাক্ষ্য-প্রমাণাদি নিয়েছেন। এখনো তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

জানা গেছে, কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহন শাখায় রামুর লম্বরীপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র লোকজনের জমির ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় এখনো তোলপাড় চলছে। দীর্ঘদিন ভূমি অধিগ্রহন শাখায় দৌড়ঝাপ ও মামলা-মোকদ্দমা করে হয়রানি হওয়ার পরও তাদের কাংখিত ক্ষতিপূরণের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালাল চক্র। ফলে ২০টিরও বেশী দরিদ্র পরিবার এখন হতাশ। লুট হওয়া এ বিশাল অর্থ উদ্ধার করে জমির প্রকৃত মালিকদের বন্টনের দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক ও এলাকাবাসী।

লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, ৪টি মামলায় বাদী-বিবাদী ৬০ জনের বিরোধীয় জমির ক্ষতিপূরণের এ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে ভূয়া আপোষনামা দেখিয়ে। অথচ এসব মামলার একটিও বর্তমানে আপোষ নিষ্পত্তি হয়নি। অর্ধ শতাধিক মানুষের ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা উত্তোলন হলেও প্রকৃত মালিকরা জমির ক্ষতিপূরণের কোন অর্থই পাননি।

এনিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা ইতিপূর্বে দূদকে তদন্ত চলাকালে ২ কোটি টাকা লুটের বিষয়ে অনিয়মের নানা তথ্য দিয়েছেন। দুদকের কাছে তদন্ততাধিন মামলার বাদী আবুল কালাম জানান, এ জমি নিয়ে ৯০/১৮ নং মামলা ছাড়াও কক্সবাজার বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে আরো ৩টি মামলা মামলা (নং যথাক্রমে অপর-২০৭/১৮, মিচ মামলা নং ১২/২০১৭, অপর ৩৭০/২০১৮ বিচারাধিন রয়েছে। এরপরও বিজ্ঞ আদালতের প্রতি কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে লোভের বশবর্তী হয়ে সার্ভেয়ার মাসুদ রানাসহ আরো কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী-দালাল চক্র যোগসাজশ করে প্রকৃত ভূমি মালিকদের প্রায় ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

তিনি আরও জানান, অপর-৯০/২০১৮ ও অপর ২০৭/২০১৮ নং মামলায় স্বত্ত¡ নাদাবী আপোষ-নামায় গন্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে স্বাক্ষর করেন, সদর উপজেলার বাংলাবাজার এলাকার শামসুল আলম, রশিদনগর ইউনিয়নের মুরাপাড়া এলাকার শাহজাহান, লম্বরীপাড়া এলাকার জাফর আলম, এনামুল হক, নুরুল কবির। এসব ব্যক্তিরা জমির মালিকও নয়। কিন্তু এসব ব্যক্তিরা নুরুল হক গং, রাশেদা গং, সিরাজুল হক গং এর নামে ওয়ান ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের একাউন্টে জমাকৃত ভূমি অধিগ্রহণের টাকা চেকের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন।

আরো জানা গেছে, নুরুল গং এর নামে জমাকৃত ২ কোটি টাকার মধ্যে সার্ভেয়ার মাসুদ রানা দালাল শাহজাহানের মাধ্যমে গ্রহণ করেন ৫৫ লাখ টাকা। যা অগ্রিম চেকের মাধ্যমে নেয়া হয়। এছাড়া অপর ২০৭/২০১৮ নং মামলার বাদিদের দেয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা, অপর-৯০/২০১৮ নং মামলার বাদিদের দেয়ার জন্য ২৫ লাখ টাকা নেয় দালালরা। এছাড়া অন্যান্য মামলার বাদি-বিবাদীদের ক্ষতিপূরণের আরো ৯০ লাখ টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে ভূমি অধিগ্রহন শাখার কর্মকর্তা ও দালাল চক্র। ইব্রাহীম খলিল কথিত সার্ভেয়ার-দালালদের সাথে আতাঁত করে আপন-ভাই বোনদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। একারণে দুদকের অভিযোগ তদন্তকালে তিনি ইব্রাহীম খলিল, সার্ভেয়ার মাসুদ রানা, দালাল শাহজাহান সহ জড়িতদের বিরুদ্ধে লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন ইব্রাহীম খলিলের বড় ভাই নুরুল হক। সম্প্রতি নুরুল হক মারা যান।

রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের খোন্দকারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ হোসনের ছেলে মামলার ২ নং স্বাক্ষী ওসমান গনি জানান, তাঁর স্ত্রী জাহান আরা বেগম এ জমির ওয়ারিশ এবং বিজ্ঞ আদালতে চলমান অপর ৯০/২০১৮ নং মামলায় তিনি ও তার ভাইয়েরা ৬-১৩ নং বাদি। বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের জন্য ভূমি অধিগ্রহন শাখার কর্মকর্তা সহ বিবাদীদের শোকজ করার আদেশ ছিলো। কিন্তু এ আদেশ উপেক্ষা করে দালাল চক্রের সহায়তায় সার্ভেয়ার মাসুদ রানা-দালাল শাহজাহান সহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিরা ভুয়া আপোষ-নামা সৃজন করে জাহান আরা গং এর প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণের টাকা কৌশলে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে।

ওসমান গনি আরও জানান- ক্ষতিগ্রস্ত ২০ টি পরিবারের শত বছরের পুরনো বসত বাড়িতে রেল লাইন নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু এখনো তারা ক্ষতিপুরণ পাননি। নাছির মোহাম্মদ গং এর দুটি, ইসলাম গং এর একটি এবং কবির আহমদ গং এর ১টি সহ মোট ৪টি মামলা বিজ্ঞ সহকারি জজ আদালতে এখনো বিচারাধিন রয়েছে। এসব মামলার প্রেক্ষিতে ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তাদের মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অধিগ্রহনের টাকা হস্তান্তর না করার জন্য বিজ্ঞ আদালতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এসব আদেশের তোয়াক্কা না করে আদালতের অগোচরে ভূয়া আপোষনামা দেখিয়ে এলও অফিসের কতিপয় দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং চিহ্নিত দালাল শাহজাহান ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা নিজেরাই আত্মসাৎ করে। ফলে প্রকৃত মালিকরা এখনো টাকা না পেয়ে বিচারের জন্য আদালত, প্রশাসন ও দুদকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। তিনি এ অনিয়মের সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার পেতে দুদকের আন্তরিক ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন।

তিনি আরও জানান, আজ ১১ অক্টোবর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিতব্য দুদকের গণশুনানিতে উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়ার উদ্দেশ্যে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওসমান গনি। তিনি এ বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় নিয়ে ২০টি পরিবারের ক্ষতিপূরণের অর্থ ফিরে পেতে দুদকের আন্তরিক হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

নোটিশের প্রেক্ষিতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর দূর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয় কক্সবাজারের উপ সহকারি পরিচালক তাপছির বিল্লাহর কাছে লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক আবু তাহের। তিনি জানিয়েছেন- রেল লাইন নির্মানের জন্য তিনিসহ নাছির মোহাম্মদকে ৭ ধারার নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু তাদের ভূমি অধিগ্রহনের ২ কোটি টাকা কক্সবাজার এলও অফিসের কতিপয় দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং চিহ্নিত দালাল শাহজাহান ও মামলার বিবাদী আবুল হোছন, আজিজুল হক, ইব্রাহীম খলিল, রাশেদা, আনোয়ারা বেগম ছলচাতুরীর মাধ্যমে উত্তোলন করে ভাগবাটোয়ারা করেন। এ কারণে জমির প্রকৃত মালিক নাছির মোহাম্মদ গং এর ২০টি পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়।

পাঠকের মতামত: