এম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ॥
কক্সবাজারে দুই পৌরসভা ও ১৯ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একক প্রার্থী মনোনয়ন নিতে বিতর্কিত অনেকে নৌকার টিকিট পেতে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী বিতর্কিতদের কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। মনোনয়ন নিয়ে আগ্রহী আবার কেউ কেউ মানবপাচার ও ইয়াবা পাচারের অভিযোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্তও। বিতর্কিত এসব লোকজন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে নানা কৌশলে দলীয় মনোনয়নের জন্য দৌঁড়ঝাপ শুরু করায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মিদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্ঠি হয়েছে।
আগামী ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে কক্সবাজারের চকরিয়া ও মহেশখালী পৌরসভার নির্বাচন। এর দুইদিন পর ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে টেকনাফ, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী উপজেলার ১৯ টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। কক্সবাজারে প্রথম দফায় ঘোষিত তফশিলে দুই পৌরসভা ও ১৯ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিন ২২ ফেব্রুয়ারী।
নির্বাচনী বোর্ড গঠনের মাধ্যমে দলীয় একক প্রার্থী নির্ধারণ করে কেন্দ্রের কাছে পৌঁছানোর জন্য জেলার নেতাদের নির্দেশ দেয় হয় গত বুধবার। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ ছয় জনের মনোনয়ন বোর্ড কেন্দ্রের কাছে একক প্রার্থী নির্ধারণ করে পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকাগুলোর সাংগঠনিক ইউনিটের বর্ধিত সভা করে একক প্রার্থীদের নাম জেলার নেতাদের কাছে সুপারিশ করে পাঠিয়েছেন। এর বাইরেও দলীয় টিকিট (নৌকা প্রতীক) পেতে অনেকে জেলার নেতাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। মঙ্গলবার বিকাল অবধি দলীয় একক প্রার্থী মনোনয়ন করতে পারেননি নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ড।
তবে জেলার দুই পৌরসভা ও ১৯ ইউনিয়নে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে একক প্রার্থী দেওয়ার কাজ চলছে বলে জেলার আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন। নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ডের কাছে যারা আবেদন করেছেন তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা থাকার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয়দের কাছে।
স্থানীয়রা জানান, গত ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের জামায়াত প্রার্থী হামিদুর রহমান আজাদের পক্ষে ঘামঝরানো প্রচারণা চালান এমন ব্যক্তিও আওয়ামীলীগের প্রার্থী হতে চান।
যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের সাবেক দেহরক্ষী আকতার হামিদের ভগ্নিপতি কুতুবদিয়ার লেমশিখালী ইউনিয়নের আকতার কামাল। একসময় তিনিও জামায়াত ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তবে গত কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সহ- সভাপতি হন। কিন্তু কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা বিষয়টি অবহিত হয়ে তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেন। মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা এটি। তিনিও নির্বাচনে নৌকার টিকিট পেতে জেলার নেতাদের কাছে মরিয়া হয়ে জোর তদবির শুরু করেছেন।
একই উপজেলা উত্তর ধুরুং ইউনিয়নে নৌকার টিকিটে নির্বাচনে লড়তে চান মোহাম্মদ সিরাজদ্দৌল্লাহ। যার ভাই ও নিকটাতœীয়-স্বজন সবাই বিএনপির -জামায়াতের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তবে তিনিও জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। গত বছর-তিনেক আগে থেকে তিনি পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে শুরু করেন। এক সময়ের জামায়াতের দূর্ধর্ষ এ ক্যাডার এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়তে জোর তদবির শুরু করেছেন।
এব্যাপারে জামায়াতের সাবেক নেতা সিরাজদ্দৌল্লাহ’র মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
মোহাম্মদ সিরাজদ্দৌল্লাহ একসময় জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলেও আকতার কামালের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুচ্ছাফা।
তিনি বলেন, কুতুবদিয়ার ৬টি ইউনিয়নের একক প্রার্থী নির্ধারনে ইউনিয়ন কমিটিগুলোর বর্ধিত সভা করেছি। তা সুপারিশ করে জেলার নেতাদের কাছে জমাও দিয়েছি। তবে জামায়াত-বিএনপি থেকে আসা লোকজন যাতে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না পায় সেই ব্যাপারেও জেলার নেতাদের কাছে দাবি জানানো হয়েছে বলে জানান আওয়ামী লীগ নেতা নুরুচ্ছাফা।
মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এক বিএনপি নেতা নৌকার টিকিট পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। একই ইউনিয়নে মনোনয়ন চান সদ্য জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া এক নেতাও।
জানা গেছে, ছোট মহেশখালী ইউনিয়নে নছির উল্লাহ খান, ফরিদুল আলম ও আব্দুস সামাদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন। এদের মধ্যে নছির উল্লাহ খান ছাড়া অন্য দুইজনের একজন সাবেক জামায়াত নেতা এবং আরেকজন বিএনপি নেতা ও পিতা ছিলেন রাজাকার। বিএনপির এ নেতার পিতা বাঁচা মিয়ার মৃত্যু না হলে তিনিও মহেশখালীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আসামী হতেন।
ছোট মহেশখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য লিয়াকত আলী বলেন, ফরিদুল ইসলাম কয়েকমাস আগে জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। আর আব্দুস সামাদ ইউনিয়ন বিএনপি নেতা। অথচ তারা নৌকার টিকিট চান। এ ধরনের ‘সুযোগ সন্ধানীদের’ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না দেওয়া দাবি জানান তিনি।
বিএনপি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে কেন মনোনয়ন চাইছেন তা জানতে চাইলে আব্দুস সামাদ কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি। একইভাবে জানতে চাইলে ফরিদুল ইসলামও কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।
মহেশখালীতে নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ডের কাছে জামায়াত-বিএনপি থেকে আসা এসব নেতারা দলের টিকিট চাওয়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মি ও সমর্থকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন দলের সাথে ছিলেন এবং ত্যাগী নেতা-কর্মিরা মনোনয়ন বঞ্চিত হলে নির্বাচনী ফলাফল ঘরে তুলে আনা নিয়ে সংশয় রয়েছে তৃণমূলের।
মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ সভাপতি প্রয়াত ইমাম হোসেন চৌধুরীর সন্তান শাহরিয়ার চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগ পরিবারেরই সন্তান। ছাত্রজীবনে সংগঠনের বড় কোন পদে না থকেলেও জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের সাথে। তিনিও ছোট মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে দলের বোর্ডের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সহ আবেদন জানিয়েছেন।
জামায়াত-বিএনপি থেকে দলে ভেড়া এসব লোক দলের মনোনয়ন চাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এতদিন ধরে দলের জন্য এতো ত্যাগ কি তাহলে বিফলে যাবে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মিদের মনোনয়ন দেয়া না হলে তৃণমূলে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী জানান, মহেশখালী উপজেলার ৭ ইউনিয়নের জন্য আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী দেওয়া হবে। একক প্রার্থী নির্ধারণে কয়েকদিন ধরে কাজ চলছে।
তিনি জানান, বিএনপি-জামায়াত নেতাদের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার খবর আমরাও শুনেছি। এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক রয়েছি।
এছাড়া টেকনাফে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এমন কেউ নৌকার টিকিট না চাইলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী ও মানবপাচারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিরাও নৌকার টিকিট পেতে জোর তদবির চালাচ্ছেন জেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে। এমন অভিযোগ রয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের। কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনও।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান জানান, কোনো মনোনয়ন প্রত্যাশীর সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের মনোনয়নের জন্য নির্বাচিত করা হবে না।
জেলা আওয়ামী লীগের নব নির্বাচিত সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা জানান, অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশী থেকে কেন্দ্রীয় নির্দেশ মোতাবেক যোগ্য ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি জানান, আমরা আশা করি কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী বলে কোনো কিছু আওয়ামী লীগে হবে না। আমরা সেভাবে কাজ করছি। একক প্রার্থী নিশ্চিত করে আমরা জয় ছিনিয়ে আনব। এরপরও কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠকের মতামত: