ঢাকা,বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০২৪

এসএসসির স্কুলশিক্ষার্থীদের থেকে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা আদায়, এখনো ফেরত দেয়নি

sscচকরিয়া নিউজ ডেস্ক :::

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চলমান এসএসসির ফরম পূরণ এবং নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সময় অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়ে তোলপাড় চলছে। জেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা অতিরিক্ত ফি আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা ধরে তদন্ত করছেন। আগামীকালের মধ্যে জেলা শিক্ষা অফিসগুলো তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। বোর্ডগুলো ১১ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করবে মন্ত্রণালয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্কুলের ব্যবস্থাপনা বা ম্যানেজিং কমিটি বাতিল এবং শিক্ষকদের এমপিও বন্ধসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এ দিকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ ২৮ জন শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজন এক বিবৃতিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অতিরিক্ত ফি আদায়ের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অযৌক্তিক ভর্তি ফি ও বেতনবৃদ্ধি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিবৃতিতে শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনরা আদালতের নির্দেশনার আলোকে অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক প্রয়াস বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ গ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর তদন্ত চলছে : শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলো সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে আড়াই হাজারেরও বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কয়েক কোটি টাকা আদায় করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা শিক্ষা বোর্ডগুলোয় পাঠানো হয়েছে। বোর্ডগুলো এখন জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের দিয়ে তা তদন্ত করে দেখছে।
সাড়ে ১৫ কোটি টাকার বেশি হাতিয়েছে স্কুলগুলো : জানা গেছে, এবার এসএসসিতে ফরম পূরণের জন্য বিজ্ঞান শাখায় ১৪৫৫ টাকা, মানবিক ও বাণিজ্য শাখার ১৩৫৫ টাকা ধার্য করা হলেও ঢাকা বোর্ডের অধীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করেছে সাড়ে ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা করে। আদায়ের হার একেক বোর্ডে একেক রকম ছিল। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সাধারণ আট বোর্ডে ও মাদরাসা বোর্ডে ১৫ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৯ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, যদি নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত মাত্র ১ হাজার টাকা করেও বেশি আদায় করা হয় তা হলে, ১৫ কোটি ৫৩ লাখ ১৩৯ হাজার অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ এর জন্য কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে না স্কুলগুলোকে।
শিক্ষা বোর্ডগুলো সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রেরিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সারা দেশের ৯টি বোর্ডের (সাধারণ আট বোর্ড ও মাদরাসা) অধীনে ২৫১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে অতিরিক্ত ফি আদায়ের ব্যাপারে। এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডে রয়েছে, ৮৮৭টি প্রতিষ্ঠান, যশোর বোর্ডে ১৫১টি, বরিশাল বোর্ডে ৯৩টি, দিনাজপুর বোর্ডে ১৯৪টি, চট্টগ্রাম বোর্ডে ১৯টি, কুমিল্লা বোর্ডে ১৭৫টি, সিলেট বোর্ডে ৬০টি এবং মাদরাসা বোর্ডের অধীনে ৩৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করেছে।। মাদরাসা বোর্ডের অধীনে ঢাকা বিভাগের ১৪২টি, রাজশাহী বিভাগের ১৮২টি, কুমিল্লা বিভাগে ৫টি, বরিশাল বিভাগে ৩৫টি, রংপুর বিভাগে ১২টি এবং খুলনা বিভাগে ৫টি বেসরকারি মাদরাসা দাখিল পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করেছে। এর বাইরে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
চিহ্নিতগুলোর বাইরে অতিরিক্ত ফি আদায়কারীদের শনাক্তের নির্দেশ : চিহ্নিত ২৫১১টি প্রতিষ্ঠানের বাইরেও যেসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত ফি আদায় করেছে তাদেরকেও তদন্তের আওতায় আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বোর্ডগুলোকে। গত পরশু (৭ ফেব্রুয়ারি) মাউশিতে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডগুলো এবং জেলা শিক্ষা অফিসগুলোকে এ নির্দেশ কার্যকর করতে বলা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বা ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করা হবে।
অতিরিক্ত ফি ফেরত দেয়ার সময় শেষ হচ্ছে ১১ ফেব্রুয়ারি : এসএসসির ফরম পূরণের সময় অতিরিক্ত ফি ফেরত দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া (৭ কার্যদিবস) সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি। গত ৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। এর পর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলোর নিয়ন্ত্রক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ‘অতিরিক্ত ফি আদায়’ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, সব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। এ বৈঠকে ‘অতিরিক্ত ফি আদায়’-এর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনাও হয়। এটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভা হলেও এখানে ‘অতিরিক্ত ফি আদায়ে’-এর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে ‘ত্বরিতগতিতে’ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বৈঠক সূত্র জানায়, ‘মন্ত্রী বলেছেন, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না ’।
মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ে পদক্ষেপে ২৮ জন শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীর সমর্থন : এ দিকে গত ‘অতিরিক্ত ফি আদায়ে’-এর ব্যাপারে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ ২৮ জন শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজন গত ১৭ জানুয়ারি যে বিবৃতি দিয়েছে তা নিয়ে গতকাল দুপুরে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের নেতৃত্বে চারজন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হায়াত মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ ও মোস্তাফিজুর রহমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। তারা শিক্ষামন্ত্রীর সাথে একান্ত বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। এ সময় সুলতানা কামাল বলেন, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বিগত কয়েক বছর দেশ নানা দিক থেকে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। শিক্ষার মান ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত ফি আদায় প্রসঙ্গটি অন্যতম।
এম এম আকাশ বলেন, অতিরিক্ত ফি আদায়কারীদের তা ফেরত দিতে হবে। এর সাথে কোনো আপস নেই। কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান নিজের নিয়ম নিজে চালু করতে পারেন না। তাকে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে পরিচালিত হতে হয় এবং কিছু বিধিবিধান ও নিয়মের অধীনে পরিচালিত হতে হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যা করেছে তা তারা করতে পারে না।
অতিরিক্ত ভর্তি ফি ফেরত সংক্রান্ত বিষয়ে আইন ও মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা মেনে চলার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়ে পরে শিামন্ত্রী বলেন, অতিরিক্ত ভর্তি ফি অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। নইলে উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২৮ শিক্ষাবিদ বিবৃতিতে যা বলেছেন : বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিশিষ্টজনেরা বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, সম্প্রতি অনেক বেসরকারি স্কুলে শিক্ষাবছরের শুরুতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বেতন, ভর্তি ফি ইত্যাদি আদায় করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি স্কুলে একলাফে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ ফি বাড়ানোর ফলে অভিভাবকদের ওপর বাড়তি বোঝা ও অনভিপ্রেত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি নীতিমালার বাইরে বেতন ও ভর্তি ফি বৃদ্ধির এই ঘটনা ক্রমাগত অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এক দিকে অভিভাবকেরা রাস্তায় নামছেন, অন্য দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের অনমনীয মনোভাবের কারণে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়। আমরা বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে এহেন অতিরিক্ত ফি আদায় করার সব ধরনের অপপ্রয়াসের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা আশা করছি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলো মহামান্য আদালতের নির্দেশনার আলোকে এই অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক প্রয়াস বন্ধে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং সংবিধানে বর্ণিত সবার জন্য শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সহায়তা করবেন।
বিবৃতিদানকারী বিশিষ্টজনদের মধ্যে অন্যতমরা হচ্ছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সেলিমা হোসেন, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, এম হাফিজউদ্দি খান, এ্যারোমা দত্ত, হোসেন জিল্লুর রহমান, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক শফি আহমেদ, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. মনজুর আহমেদ প্রমুখ।

পাঠকের মতামত: