ইমাম খাইর :::
কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৭ লাখ মানুষের জীবন, সহায়-সম্পত্তি রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ খুবই জরুরী। এখন আর ত্রাণ বা অনুদান চায়না উপকূলের মানুষরা। তারা চায় জীবনের নিরাপত্তা। পানি উন্নয়নবোর্ড এবং টেন্ডারিং-এ স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রয়োজন কংক্রিট/সী-ডাইক পদ্ধতিতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ। তাছাড়া পানি উন্নয়নবোর্ডের সংস্কার করে আলাদা উপকূলীয় উন্নয়নবোর্ড চায় এখানকার বাসিন্দারা। ঝড়-তুফান ও ঘূর্ণিঝড়ের প্লাবন এখনও উপকূলের লোকালয়ে হানা দেয় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে। উপকূলের মানুষ এখনও স্বস্তি নিয়ে বসবাস করতে পারছে না; ঝড়-জোয়ারের প্লাবন প্রতিরোধী একটি বেডিবাঁধের অভাবে। বেড়িবাঁধের জন্য সরকারের বরাদ্দের কাজও যথাযথভাবে হচ্ছে না। স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় দ্বীপ ছেড়ে আসা মানুষ নিজেদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে সাহস পায় না। বরং এখনও উপকূল থেকে দেশান্তরী হওয়া থেমে নেই।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র ধকল কেটে না উঠতেই তীব্র ঝড়ো হাওয়ায় এবং পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় নতুন করে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। এতে করে বাড়ী ঘরে ঢুকে পড়েছে জোয়ারের পানি। লোনা পানিতে ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। অন্তত ১০টি গ্রাম নতুন করে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। নতুন করে শাহপরীর দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে ১.৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পানিতে তলিয়ে গেছে।
মোরা’র আঘাতে সাগরে অনেক মাঝি-মাল্লা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং নিখোঁজ রয়েছেন।এসব বিষয়ে সামনে এনে উপকূল রক্ষার দাবীতে জলবায়ূ অর্থায়ন বিষয়ক নাগরিক সমাজের সংগঠনসমূহের সমন্বয়ে মানববন্ধন কর্মসুচি পালিত হয়েছে।
সোমবার (১৯ জুন) কক্সবাজার পৌর ভবনের সামনের সড়কের মানববন্ধনে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার লোকজন অংশ গ্রহণ করেন।
কোস্ট ট্রাস্টের সিএফটিএম প্রকল্পের জেলা টিম লিডার মকবুল আহামদের সভাপতিত্বে এতে বক্তৃতা করেন- কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি মুহম্মদ নুরুল ইসলাম, সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজার এর সহ-সভাপতি জিএএম আশেক উল্লাহ, মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কবি রুহুল কাদের বাবুল, আওয়ামী লীগ নেতা কামাল উদ্দিন রহমান পেয়ারু, হিউম্যান ডিফেন্ডার ফোরাম কক্সবাজার এর সদস্যসচিব মিজানুর রহমান বাহাদুর, কক্সবাজার সিটি কলেজের প্রভাষক রুমানা আক্তার, দৈনিক রূপালী সৈকতের বার্তা সম্পাদক ইমাম খাইর, কুতুবদিয়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুময়িন সিকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক দিনার, এডভোকেট অবু মুসা, যুবজোট নেতা মোশারফ হোসেন প্রমুখ।
এ সময় কোস্ট ট্রাস্টের সিডস প্রকল্পের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলমসহ বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় উপকূল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংস্কারসহ দ্বীপভাঙন ও প্লাবন রোধে স্থায়ী সমাধানে ১০টি প্রস্তাবনা দেয়া হয়। যেমন:
১. নদীর তলদেশ থেকে তীরের উচ্চতা পর্যন্ত ব্লক স্থাপন: নদীর তলদেশ থেকে তীরের উচ্চতা পর্যন্ত ব্লক স্থাপন করে নদীর তীর রক্ষা করা ও একই সাথে ব্লকসমেত রিংবাঁধ দিতে হবে যাতে জোয়ারের পানি ঢুকতে না পারে। এই পদ্ধতিতে ভোলাকে নদীভাঙন থেকে রক্ষা করতে হলে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।
২. টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা: পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা হলে সিস্টেম লস কমানো যাবে।পানি উন্নয়ন বোর্ড দুর্নীতি মুক্ত হলে এবং টেন্ডারিং ব্যবস্থায় স¦চ্ছতা থাকলে মোট খরচের চেয়ে কম পক্ষে ২০% কম খরচে নদী রক্ষার প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করা যাবে।
৩. সেনাবাহিনীকে কাজে যুক্ত করণ: বাঁধ নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ কর্মকান্ডে পানি উন্নয়ন বোডের ঠিকাদারদের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে কাজ শেষ করতে সেনাবাহিনী প্রকৈাশল ইউনিটকে যুক্ত করতে হবে। যাতে তুলনা করা যায় কোন্ ব্যবস্থাপনায় কাজ টেকশই হয়।
৪. জনঅংশগ্রহণের সুযোগ রাখা: কর্মকান্ড গ্রহণ, বাস্তবায়ন এবং পরিবীক্ষণ পর্যায়ে স্থানীয় জনগণকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করতে হবে।
৫. চলমান কর্মকান্ড বিষয়ে সকল তথ্য জনগণের সম্মুখে প্রকাশ ও প্রচার করার ব্যবস্থা করা এবং অভিযোগ ব্যবস্থানার সুযোগ নিশ্চিত করা:
৬. কাজ শুরুর পূর্বে এবং কাজ চলার সময় উপকরণ মান, পদ্ধতি, সময়, বাজেট ইত্যাদি বিষয়ে সকল তথ্য উন্মুক্ত রাখা এবং প্রতিটি প্রকল্পে তথ্য অধিকার আইনের ব্যবহার সহজ করা। যাতে জনগণ চাইলেই যে কোন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ধরতে পারে এবং অভিযোগ করতে পারে।
৭. পানি উন্নয়ন বোর্ডে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জনমুখি মনোভাব গড়ে তোলা এবং জেলা পরিষদ এবং স্থানীয় সরকারের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: নদী রক্ষা পরিকল্পনা করার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জনগণের মতামত নিতে আগ্রহ দেখায় না। এই মনোভাব পরিবর্তনে ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জেলা পরিষদের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৮. পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান কাজ পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষা প্রয়োজন: উপকূল জুড়ে বাঁধ নির্মাণ ও পুণ:নির্মাণের অনেকগুলি প্রকল্প বর্তমানে চলমান আছে। আমরা চাই উক্ত প্রকল্পসমূহের কাজের অগ্রগতি ও সন্তুষ্টি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হোক। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন কর্র্তৃক সরজমিন পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষা করা হোক।
৯. ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি:বেড়িবাঁধের বাইরে ম্যানগ্রোভ বা প্যারাবন সৃষ্ঠি করে বাঁধের সুরক্ষা দিতে হবে। উপকূল রক্ষাকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিবেচনা করে ।অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
১০. ‘জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড’ থেকে জলবায়ু ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে কারা কারা কি পরিমান বরাদ্দ পেয়েছে তা প্রকল্পের নামসহ জনসম্মুখে প্রচার করতে হবে।সভায় আরো জানানো হয়- বাঁচার অধিকার মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং ধারার নাগরিকদের আশ্রয় নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ আছে। ৬০ ও ৭০ দশকে সিসিব্লক ফেলে উপকূলীয় ভাঙন রোধে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও বিগত ৪০ বছরে বৃহৎ কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বাস্তবায়িত বেশিরভাগ প্রকল্প আকারে ছোট এবং অস্থায়ী সমাধান (জিও ব্যাগ, নদীর তীর উচুকরণ, রিং বেড়ি, ইত্যাদি)।
বিজ্ঞানভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, গত ৫০ বছরে ভোলা এবং কুতুবদিয়া দ্বীপ প্রায় অর্ধেক ভূখন্ড হারিয়েছে। এবং গবেষকগণ আশংকা করছেন আগমাী ৫০ বছরে হয়তোবা এই দুটি দ্বীপ একবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যদিও দক্ষিণ মোহনায় কিছু কিছু নতুন চর তৈরি হচ্ছে কিন্তু সেখানে মানব বসতি শুরু করতে আরো ৫০-৭০ বছর সময় লেগে যাবে। তাহলে ৪ কোটি উপকূলীয় মানুষ যাবে কোথায়? তাদের কি নিজ আশ্রয়ে দেশের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার নাই? সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অস্বাভাবিক জোয়ার ঘটার হার এবং তীব্রতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নদীর গতিপ্রকৃতির কারণে প্রাকৃতিক নিয়মেই যে কোন কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হল, উপকূলীয় ভূখন্ড রক্ষা করা এবং এটা সম্ভব।
এখানে প্রযুক্তিগত সমাধান আছে কিন্তু আর্থিক সঙ্গতিতে ঘাটতি রয়েছে। ভোলা, কক্সবাজারসহ অন্যান্য উপকূলীয় জেলায় কর্মরত উন্নয়ন সংস্থাসমূহ মনে করে, আর্থিক সঙ্গতির ঘাটতি স্থায়ী কোন প্রতিবন্ধকতা নয়। এখানে প্রয়োজন সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী এবং উপকূলের মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে ভাঙন রোধে কাজ করার দৃঢ়তা। কিন্তু এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড যাদের লোকবল, কাজের ধারা, সবই গতানুগতিক রয়েয়ে গেছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ বৃদ্ধি, চলমান দুর্নীতি কমানো, টেন্ডারিং প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন ইত্যাদিসহ সার্বিক সংস্কার জরুরি।
স্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগী মনোভাব বেশি প্রয়োজন। তার চাইতে গুরুত্বপুর্ণ হলো সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মদক্ষতার উন্নয়ন। গতানুগতিক লোকবল ও কর্মকৌশল দিয়ে বর্তমানে বাঁধ নির্মান ও উপকূলীয় জমি ও মানুষের সুরক্ষায় কর্মকান্ড বাস্তবায়ন সম্ভব না। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংস্কার ও আধুনিকায়ন জরুরী।
এদিকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর অব্যবস্থাপনায় হুমকির মুখে পড়েছে কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুত প্রকল্প। জোয়ারের পানির ধাক্কায় ৩ কিলোমিটার ব্যাপী প্রকল্পের প্রতিটি পিলারের গুড়া থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রকল্পভুক্ত জায়গা। ইতিমধ্যে ১৫টিরও বেশী পাখা অচল হয়ে গেছে। থেমে আছে সংস্কার কাজ।
এ প্রসঙ্গে কুতুবদিয়া-পেকুয়া-চকরিয়া এলাকায় দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়নবোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (বান্দরবান) শফিকুল ইসলাম শেখ জানান, পুরো দ্বীপে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য ৯২ কোটি টাকার সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। বায়ুবিদ্যুত এলাকার ৪ কিলোমিটার জায়গা জিও ব্যাগ স্থাপনের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা হবে।
পাঠকের মতামত: