ঢাকা,মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪

অরক্ষিত বাঁধ, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ, শঙ্কিত ২০ হাজার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে গোমাতলীতে

32222সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও (কক্সবাজার ) প্রতিনিধি ::

কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীতে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ক্ষতির প্রভাবটা পড়েছে। পশ্চিমের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্থ হয়ে বঙ্গোপসাগরের জোয়ার-ভাটার বৃত্তে বন্দী রয়েছে এ এলাকার মানুষ। ১৯৯১ সালে আঘাত হানা প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড়’র ক্ষত এখনো মুছেনি তাদের।

এদিকে বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনের পর থেকে ঈদগাঁও থেকে গোমাতলীর যোগাযোগের প্রধান সড়কটি জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে জোয়ারের সময় নৌকায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয়। ভাটার সময় এ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। বিকল্প আর কোন উপায় না থাকায় যে কোন দূর্যোগকালীন সময়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের সুযোগ নেই এলাকার মানুষের।

অন্যদিকে সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের বৃহত্তর গোমাতলীর প্রায় ২০ হাজার মানুষের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৫ টি। এসবের আনুমানিক ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১ হাজারের বেশি নয়।

এ বিষয়ে পোকখালী ইউপি মেম্বার আলাউদ্দিন জানান, এলাকায় যে আশ্রয় কেন্দ্র গুলো রয়েছে তাতে দূর্যোগকালীন সময়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার মত মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। ২০ হাজার বাসিন্দা অধ্যুষিত বৃহত্তর এই জনপদের জন্য তা অত্যন্ত নগন্য।

সুত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা বড় বিপদে বেড়িবাঁধ, সড়ক , আশ্রয়কেন্দ্র সবই নিরাশ করছে গোমাতলীর বাসিন্দাদের। ১মাস ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে ২০ হাজার মানুষের বসতিস্থল গোমাতলী। বেড়ীবাঁধ বিলীন হয়ে ধীরে ধীরে ৫ গ্রাম সম্পূর্ন বিলীন হয়েছে। ৩’শ পরিবারের বসত ভিটা বিলীন হয়ে অন্তত ২ হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্ধাস্তুতে পরিণত হয়েছে। উদ্ধাস্তুতে পরিনত হওয়া এসব মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববতী ঈদগাঁওর পাহাড়ী এলাকাসহ বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। বেড়ীবাঁধ নির্মিত না হওয়ার ফলে এ এলাকার ২০ হাজার মানুষের জলবায়ু উদ্ধাস্তুতে পরিণত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

সদর উপজেলার উপকূলীয় পোকখালী ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গোমাতলীর অবস্থান। আদতে এটি কোন দ্বীপ না হলেও গত ১মাস ধরে বেড়ীবাঁধ ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানকার মানুষেরা দ্বীপের মানুষের মতো জীবন যাপন করে যাচ্ছে। একদিকে বেড়ীবাঁধ না থাকায় প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটায় বসবাস করছে হাজারো মানুষ। অপরদিকে ৩ কিলোমিটার বিধ্বস্থ সড়ক পাড়ি দিতে দুই দফা নৌকা আর হেটে কাঁদা মাখা পথ মাড়িয়ে ১২ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদরের ঈদগাঁও পৌঁছানো এখানকার মানুষদের কাছে মহাকষ্ঠকর হচ্ছে।

গোমাতলীর বিলীন হওয়া ৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দুখু মিয়া জানান, ঈদগাঁও থেকে গোমাতলীর দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার হলেও বিধ্বস্থ এই ভাঙ্গা অংশের কারনে বর্তমানে এই ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কয়েক গুন অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি কয়েক ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। তার উপর নৌকা, সিএনজি নিয়ে কয়েকদফা গাড়ী বদলিয়ে আসা যাওয়া যেন সেই প্রাচীন যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় এলাকাবাসীকে। সবচেয়ে বেশী দূর্ভোগ পোহাতে হয় বিধ্বস্থ সড়ক দিয়ে নৌকা পার হয়ে অসুস্থ, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের । সড়ক যোগাযোগ না থাকায় খরচ ও সময় দুই বেড়ে গেছে, বেড়েছে ভোগান্তি।

গোমাতলীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ম. ন. আবছার জানান, অবস্থা এমন হয়েছে যে জন্মস্থানে থাকা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাত ও সামাজিক কোন অনুষ্ঠান কিংবা কারও মৃত্যুতে নিতান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে এলাকায় যাওয়া, কিন্তু সড়ক যোগাযোগ না থাকায় অনেক সময় তাও সম্ভবপর হয়ে উঠেনা। অথচ সরকারের সদিচ্ছা আছে বলে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে কিন্তু গোমাতলীর বেড়ীবাঁধ নির্মিত হচ্ছেনা।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ না করলে বিচ্ছিন্ন সড়কটি সংস্কার করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন, কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগ। তারা বলছে সড়কটি মেরামতের জন্য টেন্ডার হওয়ার পরও কাজ শুরু করা যাচ্ছেনা ভাঙ্গা বেড়ীবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকার কারনে।

তবে পোকখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ জানান, সড়ক বিভাগ চাইলে কয়েক ফুট উচু করে সড়কটি মেরামত করতে পারতো। সে ক্ষেত্রে জোয়ারের পানি ঢুকলেও সড়ক যোগাযোগে কোন সমস্যা হতো না, এলাকার মানুষের যাতায়াত সমস্যা লাঘব হতো। অথচ ১ বছর ধরে নানা দোহাই দিয়ে সড়ক বিভাগ কাজে হাত দিচ্ছেনা। তিনি মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ক্ষতির প্রভাবটা পড়েছে গোমাতলীর উপর। সাগরের পানির উচ্চতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এ থেকে পরিত্রান পেতে হলে টেকসই উঁচু বেড়ীবাঁধ ও সড়ক নির্মাণ করতে হবে। না হলে গোমাতলী সাগর গর্ভে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে এখানকার ২০ হাজার মানুষ।

কিন্তু ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে গোমাতলী রক্ষা বাঁধের ১০ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে নির্মিত বেড়ীবাঁধ ২০০৭ সালের প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারের তোড়ে বড় ধরণের ভাঙ্গনের ফলে শত শত পরিবার গৃহহারা ও চাষাবাদের জমিতে লবন পানি প্রবেশ করতে থাকে। তাছাড়া সাগরের জোয়ারের পানির কারনে লবণ মাঠ, ঘের, ফসলী জমি ও বসত-ভিটায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ইতিমধ্যে সেই ভাঙ্গন দিয়ে সামুদ্রিক জোয়ারে পাড়া মসজিদসহ কয়েকশ’ বসত-ভিটা, বাড়ি ঘর সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে লোকালয় গ্রাস করছে।

ফলে সাগর উপকূলীয় গোমাতলীর এলাকার লোকজনের চোখের ঘুম হারাম হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় জোয়ারের লবন পানি ডুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। ফলে চিংড়ী ঘের, ফসলী জমি, বসত বাড়ী ও বিভিন্ন গাছপালা ধ্বংস হয়ে পড়ছে। এমনকি রাতে জোয়ারের পানি উপকূলীয় এলাকায় প্রবেশ করায় লোকজনকে ঘর-বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হচ্ছে। ফলে গত ১মাস ধরে গোমাতলীর ২০ হাজার জনগন চরম দূর্ভোগ পোহাচ্ছে।

এদিকে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সবিবুর রহমান জানান, উপকূলীয় গোমাতলীতে একটি রিং বাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে, যা বর্ষা মৌসুমের কারণে আপাতত বন্ধ রয়েছে। রিং বাঁধটি নির্মিত হলেও দূর্ভোগের অবসান হবে বলে মনে করেন তিনি।

গোমাতলী উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দরা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড শুস্ক মৌসুমে কোন কাজ না করে বর্ষার আগে বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ কাজে হাত দেয় ফলে বাঁধের কাজ শেষ করতে পারেনা। ফলে বছর বছর গোমাতলীর দূর্ভোগ আর শেষ হচ্ছেনা। বিগত ১ বছরের এ দূর্ভোগ দূর্দশা থেকে নিস্কৃতি চায় গোমাতলীবাসী। গোমাতলী ২০ হাজার মানুষের এখন প্রানের দাবী ও বাঁচার দাবী বেড়ী বাঁধ নির্মাণ,এজন্য তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

পাঠকের মতামত: