ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫

অতিরিক্ত শব্দ দূষণের ফলে আগামী প্রজন্ম শ্রবণ শক্তি হারাবে

zআবদুর রাজ্জাক, কক্সবাজার-

কক্সবাজার জেলাসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরেই বেড়েই চলছে শব্দদূষণ। নীতিমালা আছে কিন্তু তার কোন প্রতিকার নেই। শুধু কক্সবাজার জেলায় নয়। দেশের প্রতিটি শহরেই বর্তমানে এই শব্দ দূষণের শিকার। ফলে আগামী প্রজন্ম হারাবে শ্রবণশক্তি। শ্রবণশক্তিই নয়, শব্দ দূষণের কারণে উচ্চরক্ত চাপ, মাথাধরা, অজীর্ণ, পেপটিক আলসার, অনিদ্রা ও ফুসফুসে সহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত শব্দ দূষণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা নষ্ট হয়, সন্তান সম্ভাবনা মায়েদের যে কোনো ধরনের উচ্চ শব্দ মারাতœক ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, যানবাহনের শব্দ দূষণে ষ্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ায় বহুমাত্রায়। এক জরিপে উঠে আসা শব্দ দূষণের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। যা সত্যিই আতংকজনক। সারা বিশ্বে এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার পালিত হয় ‘আর্ন্তজাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস’। সারা বিশ্বেই এই দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে তেমন সচেতন নয়।
বাংলাদেশে রয়েছে শব্দ দূষণ নীতিমালা। ২০০৬ সালে প্রণীত এই নীতিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা হলো ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। একই ভাবে, নীরব এলাকার জন্য এই শব্দসীমা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫ ও ৭০ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর উপরে শব্দ সৃষ্টি করা দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশে এই বিধিমালা মানা হচ্ছে না।
রাস্তায় বেরুলেই দেখা যায় এই শব্দ দূষণের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ট্রাক ওভারটেক করতে চায় বাসকে, বাস ওভারটেক করতে চায় প্রাইভেট কারকে, প্রাইভেট কার ওভারটেক করতে চায় এ্যাম্বুলেন্সকে। আর এসব প্রতিযোগিতার মধ্যে আছে প্যাঁ পুঁ শব্দে জোরে হর্ণ বাজানো। উন্নত দেশগুলো অবশ্য শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি কঠিন রোগের উৎস ১২ রকমের পরিবেশ দূষণ, এর মধ্যে অন্যতম শব্দদূষণ। শব্দদূষণের ফলে সৃষ্ট সমস্যাবলীর মধ্যে রয়েছে কানে কম শোনা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং সামাজিক ভীতি। এছাড়া অস্থিরতা, উচ্চরক্তচাপ ও শব্দভীতি অন্যতম। শুধু গাড়ির হর্নই নয় জনসভায় ব্যবহৃত মাইকগুলোও একে অন্যের চাইতে জোরে চিৎকাররত। মার্কেটেগুলোতে বাজছে উচ্চশব্দের বিভিন্ন গান। শুধুমাত্র একটা শব্দদূষণ বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়া সরকারের আর কোন উদ্যোগই চোখে পড়ে না। এগিয়ে আসছে না কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা এনজিও।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, যদি টানা ৮ ঘন্টা ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ প্রতিদিন শোনা হয়, তাহলে ২৫ বছরের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বধির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শব্দ দূষণ চোখ ও মাথার বিভিন্ন সমস্যার জন্যও দায়ী। শহরের বেশীরভাগ মানুষই মাথার যন্ত্রণায় ভোগে-যার অন্যতম কারণ শব্দ দূষণ। এছাড়া ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে মানুষ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক এমনকি লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জেলা উপজেলা ও শহরে যেভাবে শব্দ দূষণ বেড়ে চলেছে তাতে এ সব এলাকার অর্ধেক মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা আগামী ২০১৭ সালের মধ্যে ৩০ ডেসিবেল পর্যন্ত কমে যাবে। মানুষের ব্যক্তিগত অদূরদর্শী কার্যকলাপ, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপরিকল্পিত বিস্তার, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারের বিবর্তিত শব্দের ব্যাপকতায় শব্দ দূষণ বর্তমান সময়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় শিল্পকারখানায়, পরিবহন পদ্ধতিতে এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত সুনির্দিষ্ট তীব্রতা সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বাস, ট্রেন, জাহাজ, শিল্প-কারখানা থেকে বের হওয়া শব্দ এবং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারের শব্দের তীব্রতা নির্দেশিত মাত্রায় বা তার নিচে বজায় রাখা উচিত। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকা প্রয়োজন। যানবাহন থেকে বের হওয়া শব্দের ব্যাপকতা এবং তীব্রতা হ্রাসের জন্য আইন করে উন্নত প্রযুক্তির ডিজেল ইঞ্জিন এবং এক্সসট গ্যাস পাইপে সাইলেন্সারের ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যান্ড সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যার ফলে এ সময় অনাকাক্সিক্ষতভাবে শব্দ দূষণ সৃষ্টি হয়ে আশেপাশে থাকা শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীসহ প্রায় প্রত্যেকেরই ঘুমের বিঘœ ঘটছে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব জায়গায় মোটরগাড়ির হর্ণ বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ এ আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। জেলা ও উপজেলা শহরে সাইলেন্টস জোনেও আইনশৃংখলা বাহিনীর সামনেই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজিয়ে দেদারসে ঔষধ বিক্রির নামে যন্ত্রণাদায়ক অশীল কথামালায় মাইকিং করতে দেখা যায়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী কোন এলাকা ৬০ ডেসিবেল মাত্রার বেশী শব্দ হলে সেই এলাকা দূষণের আওতায় চিহ্নিত হবে। সংস্থার হিসাব অনুযায়ী অফিস কক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণী কক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল, হাসপাতালে ২০ থেকে ৩৫ ডেসিবেল, রেস্তোরায় ৪০ থেকে ৬০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা সহনীয়। ৬০ ডেসিবেল শব্দ মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে এবং ১০০ ডেসিবেল শব্দে চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে।
উচ্চশব্দ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও অসচেতনার কারণে রাজধানীতে শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছে ৯৫ ভাগ মানুষ। অবশ্য এ শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে গাড়ির হর্ণকেই দায়ী করলেন বিষেজ্ঞরা।শব্দদূষণ বন্ধে বিধিমালা বাস্তবায়নে গাড়িচালকদের মধ্যে সচেতনতার পাশাপাশি পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের মাধ্যমে গাড়ীর হর্ণ বাজানোর জন্য সংশিষ্ট চালক ও গাড়ির বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত। শব্দদূষণ বন্ধে পুলিশ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআরটিএ এবং জেলা প্রশাসনের পরিচালিত মোবাইল কোর্টগুলোতে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ণ এর ব্যবহার রোধে আরও কার্যকারী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, অপ্রয়োজনে হর্ণ বাজালে মোটরযান অধ্যাদেশের আওতায় ২’শ টাকা জরিমানা করা হয়। তবে এ জরিমানা চালককে দিতে হয় না বলে চালকরা এ অপরাধ করেই যাচ্ছে। শব্দ দূষণ রোধে নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই।
প্রতিদিনই বাড়ছে মানুষ। রাস্তায় নামছে নতুন নতুন গাড়ি। তৈরি হচ্ছে নতুন স্থাপনা। আর এই বাড়তি মানুষের চাহিদার জোগান দিতে বেড়েছে শব্দ দূষণের মাত্রা এবং বাড়তে বাড়তে এক অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। গাড়ি চালক ও গাড়ির মালিকগণকে শব্দ দূষণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিতকরণসহ জনসচেতনতা সৃষ্টি, ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত বিধান এবং শব্দ দূষণ বিধিমালার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ করতে হবে। বিশেষ করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে সরকারকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করেন।

পাঠকের মতামত: